ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের দুদিনের মাথায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বলেছে, বিশ্বব্যাংক আবুল হোসেনের হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করতে চাপ দিয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের পর গতকাল ১ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বিশ্বব্যাংকের অভিযোগসহ নানা তদন্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুললেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিলের দুই দিনের মাথায় দুদক চেয়ারম্যান জানালেন, বিশ্বব্যাংক দুদকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বলেছিল, মন্ত্রী আবুল হোসেনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করতে হবে। কিন্তু দুদক তাদের বলে দেয়, মামলা করার আগে কোন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করার কোন সুযোগ নেই। তা ছাড়া কারও ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে হলে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তকে অনৈতিক ও অবিবেচনাপ্রসূত দাবি করে গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বব্যাংক নানাভাবে দুদকের তদন্তে অসহযোগিতা করেছে। তারা দুদকের তদন্তে হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছে। মন্ত্রী আবুল হোসেনসহ যাদের বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ এনেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এটাও দুদক আইন সমর্থন করে না। তবে তাদের বলা হয়েছিল, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তারা রাজি থাকলে তৃতীয় কেও থাকতে পারবেন। খবর দৈনিক যুগান্তরের।
১ জুলাই বিকালে দুদক কার্যালয়ে বিশেষ কনফারেন্স ডেকে গোলাম রহমান দুদকের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের পর যে প্রেসনোট দিয়েছে তাতে দুদকের তদন্তে অসন্তোষের প্রসঙ্গটিও তুলে ধরা হয়। সকাল থেকে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, কমিশনার এম শাহাবুদ্দিন ও দুদকের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট আনিসুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেন। পত্রিকাটি সূত্রের বরাত দিয়ে আরও জানায়, ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, গত বছর অক্টোবর থেকে দুদক কি কি কাজ করেছে, বিশ্বব্যাংক এই সময়ে দুদকের সঙ্গে কি ধরনের আচরণ করেছে তা তারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশের মানুষকে জানাবেন। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কাছে অফিসিয়ালি একটি চিঠি দিয়ে জবাব দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।
গোলাম রহমান, এম শাহাবুদ্দিন ও আনিসুল হক বিকাল ৩টায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। লিখিত বক্তব্যে গোলাম রহমান বলেন, ২০১১ সালের নভেম্বরের প্রথমদিকে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের লাভালিনের বিরুদ্ধে কানাডিয়ান পুলিশের তদন্তের খবর বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তখন এ অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে দুদককে কিছুই জানানো হয়নি। দুর্নীতির বিষয়টি বাংলাদেশের একটি প্রকল্পসংশ্লিষ্ট হওয়ায় দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং একজন সহকারী পরিচালককে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করে।
গোলাম রহমান বলেন, ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীকে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রেটি ভাইস প্রেসিডেন্সির পক্ষ থেকে একটি পত্র দেয়া হয়। এতে বলা হয়, পদ্মা সেতুর ঠিকাদারের প্রাক যোগ্যতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরা কমিশনের ভিত্তিতে সাকোকে এজেন্ট নিয়োগের চাপ সৃষ্টি করার অভিযোগ আনে। পত্রটির অনুলিপি দুদক চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়। দুদক অভিযোগটি ভিন্নভাবে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য একজন উপ-পরিচালককে নিয়োগ দেয়া হয়। অনুসন্ধান প্রতিবেদন পাওয়ার পর দুদক তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ‘সিনোপসিস’ (সারসংক্ষেপ) চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি এক পত্রের মাধ্যমে লিওনার্ড এফ. ম্যাককার্থিও বরাবর পাঠানো হয়। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দালিলিকভাবে অভিযোগটি প্রমাণিত না হওয়ায় তা নথিভুক্ত করা হয় এবং তা বিশ্বব্যাংককেও জানানো হয়। এ বিষয়ে তাদের কোন পরামর্শ থাকলে তা জানানোরও অনুরোধ করা হয়। গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বব্যাংক দুদকের অনুসন্ধানের শুদ্ধতার বিষয়ে প্রশ্ন না তুলে পরবর্তীতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রেটি হিসাব ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাসপোর্ট ইত্যাদি জব্দ করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ২০০৪ সালের দুদক আইন অনুযায়ী কারও ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ক্ষমতা দুদকের নেই। তবে অনুসন্ধান শেষে এজাহার দায়েরের পর আদালতের অনুমতিক্রমেই কেবল ব্যাংক হিসাব তলব সম্ভব। তিনি বলেন, স্বচ্ছতার স্বার্থে বিশ্বব্যাংককে লেখা দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সিনোপসিস সর্বসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হল।
সংবাদ সম্মেলনে গোলাম রহমান আরও বলেন, চলতি বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে কিছু তথ্য দুদককে দেয়। এতে বলা হয়, এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার নোট বইতে হাতে লেখা, ‘পার্সেন্টেস টু বি এলোটেড টু স্পেসিফাইড পারসন্স ইজ কানেকশন উইথ দ্য এওয়ার্ড অব দ্য সিএসসি কন্ট্রাক্ট’ সংক্রান্ত তথ্য ইন্টিগ্রেটি ভাইস প্রেসিডেন্সির হাতে থাকা অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কয়েকটি নাম সাংকেতিকভাবে লেখা এবং তা থেকে একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গোলাম রহমান বলেন, এ সম্ভাব্য তালিকা ছাড়া বিশ্বব্যাংক দুদককে অন্য কোন তথ্য প্রদান করেনি। বিশ্বব্যাংক অন্যান্য তথ্যাদি প্রদান করতেও অপারগতা প্রকাশ করে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করার পরপরই দুদক থেকে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এসিসটেন্স রিক্যুয়েস্ট’ পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে কানাডিয়ান তদন্ত সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগও স্থাপন করা হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত দুর্নীতির কোন তথ্য বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল ২৩ জুন থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করে। তারা পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে। একই সময় তারা কথিত দুর্নীতির তদন্তের বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনার ও আইন উপদেষ্টার সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মিলিত হন। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের গুরুত্বের বিবেচনায় এবং সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পাদিত চুক্তির আলোকে দুদক তার তদন্ত স্বচ্ছতা সমুন্নত রাখার স্বার্থে বেশকিছু বিষয়ে সম্মতি প্রদান করে, যার মধ্যে রয়েছে- দুদকের তদন্ত টিম তাদের কাছে থাকা সব ধরনের নথিপত্র, ফাইল ও তথ্য সরবরাহ করবে। দুদকের তদন্ত টিম বিশ্বব্যাংককে তাদের সব ধরনের পলিসিও সরবরাহ করবে। সরবরাহ করবে তাদের কাছে রক্ষিত সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত। পদ্মা সেতু সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাব নিয়েও বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, প্রয়োজনে বিশ্ব ব্যাংক সেতুর ব্যাংক হিসাব সম্পর্কেও জানতে পারবে। তদন্ত পর্যায়ে অভিযোগের বিষয়ে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তারা যদি সম্মত হন তবে বিশ্বব্যাংক মনোনীত একজন প্রতিনিধি সেখানে থাকতে পারবেন।
গোলাম রহমান বলেন, এভাবে দুদক তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতার সম্মতি দেয়ার পরও বিশ্বব্যাংক ‘আনসেটিসফেক্টরি রেসপন্স’-এর যে অভিযোগে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করেছে তা সঠিক বলে মনে করি না। দুদকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের আলোচনার পর তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অনভিপ্রেত ও অন্যায্য। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের পরও দুদকের তদন্ত অব্যাহত থাকবে। তদন্তে দোষী যেই হোক প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক। বিশ্বব্যাংক দুদকের কাছে কতজনের নামের তালিকা দিয়েছে জানতে চাইলে গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বব্যাংক যেসব নাম দিয়েছে তা আমরা এখন প্রকাশ করতে পারছি না। প্রকাশ করাটা সমীচীনও নয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে। জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত থাকবে। বিশ্বব্যাংক কি করেছে, সরকার ঋণ পেল কিনা সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক বলেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের প্রস্তাব দিয়েছিল, তারাও একটি অতিরিক্ত প্যানেল করে দুদকের তদন্ত রিভিউ করবে- এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। আমরা তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না- এমন সিদ্ধান্ত তারা নিয়ে রেখেছিল। এখন তারা আমাদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।