দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ হাজীগঞ্জ দুর্গ মুঘল আমলে নির্মিত একটি জল দুর্গ। এটি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত।ঢাকা শহর কে রক্ষা করতে সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ;সম্ভবত মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের অব্যবহিত পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মিত হয়। দুর্গটি রাজধানী ঢাকা থেকে ১৪.৬৮ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত।
ঢাকা শহরকে বহির শত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষা করতে সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তার একটি হাজীগঞ্জ দুর্গ। অন্য দুটি হলো নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা জলদুর্গ ও মুন্সীগঞ্জের ইদ্রাকপুর জলদুর্গ। মোগল স্থাপনাগুলোর মধ্যে অপুর্ব এক নিদর্শন হাজীগঞ্জ দুর্গ। এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত। বেশির ভাগ ইতিহাসবিদের মতে আনুমানিক ১৬৫০ সালে বাংলার সুবাদার মীর জুমলার শাসনামলে এই দুর্গ বা কেল্লা নির্মিত হয়। নরায়ণগঞ্জ জেলার হাজীগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে এর অবস্থান। ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপনের পর নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মিত হয়। নদীপথে যাতায়াত করা শত্রুর ওপর নজর রাখতে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নদীর কোল ঘেঁষে স্থাপন করা হতো বলেই এ ধরনের দুর্গকে জলদুর্গ বলে। সুবাদাররা শুরু থেকেই জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিরোধের উপায় নিয়ে ভাবছিলেন। সুবাদার মীর জুমলা একটি পরিকল্পনা নিয়ে প্রকৌশলীদের সাথে পরামর্শ করেন। সিদ্ধান্ত হলো ঢাকাকে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে তিনধাপে প্রতিরক্ষা দুর্গ তৈরি করতে।
জলদস্যুদের নৌকা মেঘনা নদী দিয়ে এসে ধলেশ্বরী মোহনায় পড়বে। তারপর প্রবেশ করবে শীতলক্ষ্যায়। তার আগেই ইদ্রাকপুর থেকে ধলেশ্বরীর মোহনায় কামানের গোলা ছোড়া হবে। এরপরও যদি জলদস্যুদের নৌকা শীতলক্ষ্যায় প্রবেশ করে তখন সোনাকান্দা দুর্গ থেকে কামানের গোলা ছোড়া হবে। আর শেষ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে হাজীগঞ্জ দুর্গ। প্রথম দুই দুর্গের কামান এড়িয়ে কোনো নৌকা এগিয়ে এলে হাজিগঞ্জ দুর্গের কামানের গোলায় সে ধরাশায়ী হবে। এভাবেই তিনটি জলদুর্গ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন সুবাদার মীর জুমলা।
ইট-সুরকির তৈরি চতুর্ভুজাকৃতির এই দুর্গ। দুর্গটি বেশ চওড়া প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দুর্গের প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক বসিয়ে গুলি চালানোর ফোকর। দুর্গে রয়েছে কামান বসিয়ে গোলা নিক্ষেপ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। দুর্গের উত্তর দিকে আছে একমাত্র প্রবেশপথ। কিছুটা উঁচু এই দুর্গে ঢুকতে হলে আপনাকে প্রবেশ তোরণের প্রায় ২০টি সিঁড়ি ডিঙ্গোতে হবে। আর তোরণ থেকে দুর্গ চত্বরে নামতে হবে আটটি ধাপ। প্রাচীরের ভেতরে চারদিকে চলাচলের পথ রয়েছে প্রাচীর ঘেঁষেই।
১৯৫০ সালে দুর্গটিকে প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কার করা হয়েছে। তবে বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হাজীগঞ্জ জল দুর্গ নিয়ে কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। দূর্গের ভিতরে খোলা মাঠটিতে এলাকার লোকজন গরু ছাগলের চারণভূমি হিসাবে ব্যাবহার করে। আর বিকালবেলা ছেলেদের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার জায়গায় পরিনত হয় এমন একটি ঐতিহাসিক স্থান। দূর্গের ভিতরে প্রবেশ পথে হাতের বাম পাশে একটি উঁচু ধংসপ্রায় দালান আছে। এই দালানটির অবস্থা এতই খারাপ যে কোন সময় ভেঙে পরতে পাড়ে। এই দালানটি নদী পথ পর্যবেক্ষন করার জন্য পর্যবেক্ষন টাওয়ার হিসাবে ব্যাবহার করা হত সেই সময়ে।
দুর্গটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ মিটার, প্রস্থ ২০০ মিটার। দুর্গের একমাত্র প্রবেশ পথ উত্তর দেয়ালে। প্রবেশপথের দুই পাশে খোদাই করা খিলান আছে, যার শীর্ষ ভাগ পদ্মফুলের অলংকরণ শোভিত। দুর্গের বেষ্টন প্রাচীরের দেয়ালে ফোকর বা ছিদ্র আছে, যাতে অস্ত্র তাক করা যায়। চার কোনায় গোলাকার বুরুজ। দুর্গ প্রাচীরের শীর্ষে ওঠার জন্য সিঁড়ি আছে। বুরুজের বহির্গত অংশেও আছে গুলি চালানোর ফোকর। এক কোণে রয়েছে ইটের তৈরি একটি সুউচ্চ চৌকা স্তম্ভ। এ ছাড়া আছে কামান বসানোর উঁচু বেদি।প্রাচীরের ভেতরভাগের চারদিকে আছে ভিত থেকে ১.২২ মিটার উঁচুতে হাঁটাচলার রাস্তা।
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ক্রমেই ক্ষয়ে পড়া এ দুর্গের অভ্যন্তর এখন ব্যবহিত হয় গৃহপালিত পশুর চারণভূমি অথবা শিশু-কিশোরদের খেলার নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে। কেল্লার পথে খাসজমির ওপর পাট গুদামগুলো স্বাধীনতার পর থেকে অস্থায়ী লিজের কারণে সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ হতে থাকে। যদিও মাঝে মাঝে চলে প্রশাসনের লোক দেখানো সংস্কার যা উল্লেখ করার মতো কিছুই নয়। আর এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর ভবখুন্ন প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প বলে প্রতীয়মান হবে।
যেভাবে যাবেন:
গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে পারবেন এসি বা নন এসি বাসে। ভাড়া পড়বে ৩৬ টাকা থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে। আর কমলাপুর থেকে ট্রেনেও যেতে পারেন নারায়ণগঞ্জে। ভাড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা। নারায়ণগঞ্জ বাস বা ট্রেন স্টেশন থেকে ১৫ থেকে ২০ টাকা রিকশা ভাড়া নেবে হাজীগঞ্জ কেল্লায় যেতে।