দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ সৌদি আরবের নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যেনো এক তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে কী খাশোগি হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিই বদলে দিচ্ছে?
তুর্কির ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্কের মধ্যে বেশ টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তুরস্কই নয়, পশ্চিমা আরও বেশ কিছু দেশ; সৌদি আরবের সঙ্গে যাদের বহুদিন যাবত রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো তাদের জন্যও এই ঘটনা বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, নিষ্ঠুর এই ঘটনার মধ্যদিয়ে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যিনি আগামী কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্ব দেবেন, তার চরিত্র সম্পর্কে সত্যিকারের একটা আক্রোশমূলক চিত্র ক্রমশ: স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
জামাল খাশোগিকে খুন করার ঘটনায় খুব বেশি বিচলিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন আশা করেছিল যে পুরো ঘটনার রেশ যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হয়ে যাবে, তবে মার্কিন রাজনীতিকদের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাই এমন একটি ঘটনার পর সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে নতুন করে যাচাই করে দেখার দাবি তুলছেন।
এই বিষয়ে বিবিসির প্রতিরক্ষা ও কূটনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা জনাথন মার্কাস বলছেন যে, খাশোগিকে ঠিক কীভাবে হত্যা করা হয়েছে ও এরপর তার মৃতদেহ কোথায় এবং কীভাবে গুম করা হয়; যখন এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছিল, ঠিক তখন যে প্রশ্নটি সবার আগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তা হলো কে তাকে নির্মমভাবে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর আর কোনদিনই পাওয়া যাবে না। তবে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে করে নিশ্চিতভাবেই অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, সৌদি সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কাছ থেকেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের আদেশ এসে থাকতে পারে।
সৌদি যুবরাজ এমবিএস নামে পরিচিত, দেশের বহু ক্ষমতায় বর্তমানে তার হাতে। অনেক সৌদি বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, উপর মহলের আদেশ ছাড়া এরকম একটি জঘণ্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়। তবে এমবিএস এর সঙ্গে কতোটা সরাসরি জড়িত তা নিয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এখন প্রশ্ন হলো- তুরস্কের কাছে এই বিষয়ে আর কী ধরনের তথ্য রয়েছে? মূলত তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে।
বিবিসির সাংবাদিক জনাথন মার্কাস আরও বলেছেন, তুর্কী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সৌদি যুবরাজের সঙ্গে অনেকটা ‘ইঁদুর-বিড়ালের মতোই খেলছেন।’ এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে লোকজনকে তিনি যা বলেছেন, মনে হচ্ছে তিনি তার চাইতেও অনেক বেশি কিছু জানেন। তবে কতোটা বেশি জানেন এবং কী জানেন সেটি এখনও পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না।’
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন যে, আইনগত সব রকমের ব্যবস্থাই তারা নিচ্ছেন, তবে নাটকীয়তাও ধরে রেখেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। কারণ তিনি চাইছেন এমবিএসকে যতোটা সম্ভব চাপের মধ্যে রাখতে- এ কথা লিখেছেন বিবিসির সাংবাদিক জনাথন মার্কাস।
একটি বিষয় হলো, মূলত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় সুন্নি অধ্যুষিত এবং নিয়ন্ত্রিত দুটো দেশ হলো- সৌদি আরব এবং তুরস্ক। তারা উভয়ই চাইছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আরও বৃহত্তর নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির কারণে একদিকে তুরস্কের ভেতরে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে, অপরদিকে আবার ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার জন্যেও এটি একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাংবাদিক জনাথন মার্কাস আরও বলেছেন, এরদোয়ান যদি সৌদি আরবের ওপর এই চাপকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারেন এবং সময় মতো সেটি যদি ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি হয়তো সৌদি আরব হতে আরও বেশি বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক সাহায্য আদায় করে নিতে পারবেন; যা তুরস্কের দুর্বল অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও চাঙা করতে সাহায্য করবে।
তুরস্কের জন্যে এটি এতোটা সহজ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ঠিক ততোটাই কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ হলো ওয়াশিংটনকে একদিকে যেমন নিজেদের স্বার্থ দেখতে হবে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে তারা যেসব রাজনৈতিক মূল্যবোধের কথা বলে থাকে সেগুলোকেও রক্ষা করতে হবে। এই বিষয়টি শুধুমাত্র সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই দুটি দেশের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে এই অস্ত্র বিক্রি তার একটি অংশ মাত্র। এই সম্পর্কের পেছনে আরও রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক হিসাব নিকাশও। কোনো একসময় এই সম্পর্কের একেবারে কেন্দ্রেই ছিল তেল। তবে সেই নির্ভরতা এখন আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে।
সাংবাদিক জনাথন মার্কাস আরও লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব এই দুটি দেশের সম্পর্কে এর আগেও টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছিলো। তবে সৌদি আরবের ক্ষমতাবলয়ে এমবিএসের আবির্ভাবের পর সেটি আরও জটিল রূপ নিয়েছে। ক্ষমতায় এসেই তিনি দেশের ভেতরে সংস্কারের যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সেগুলো তার গৃহীত নীতিমালার বহু খারাপ দিককেও যেনো ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। তবে দু:খের বিষয় হলো খুব বেশিদিন চাপা দিয়ে রাখতে পারেননি। কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার মূল নায়ক হিসেবে মূলত দেখা হয়ে থাকে তাকেই। লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে কিছুদিনের জন্যে অপহরণ করে আটকে রাখার জন্যেও তাকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। অপরদিকে মানবাধিকার নিয়ে কানাডার সঙ্গে সম্প্রতি যে তর্কাতর্কি হয়েছে ও সর্বোপরি ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সামরিক অভিযানের পেছনেও দেখা হয় এই এমবিএসকেই।
এসব নানা কারণে ওয়াশিংটনে অনেকেই মনে করেন, এমবিএসের গৃহীত নীতিমালা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক তো নয়ই, বরং এর উল্টো কাজ করছে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন তাদের নীতিমালার সব ডিম রেখেছেন এমবিএসের ঝুড়িতেই।
সাংবাদিক জনাথন মার্কাস আরও বলেছেন, এসব নীতিমালার মধ্যে রয়েছে ৩টি লক্ষ্য।
প্রথমত: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা।
দ্বিতীয়ত: ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিরোধের নিষ্পত্তিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছেন সে বিষয়ে ফিলিস্তিনিদের উদ্বুদ্ধ করা।
তৃতীয়ত: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, সেটা হচ্ছে সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
এসব কারণেই ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে খাশোগির হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যে উদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটি যেনো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। যে কারণে ট্রাম্পের শাসনামলে সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে নতুন করে যাচাই করে দেখার হয়তো কোনো সুযোগ নেই।
সৌদি আরব কি তাহলে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যার কারণে যুবরাজ এমবিএসের ক্ষমতায় লাগাম টেনে ধরা হবে? তবে গত সপ্তাহে অর্থনৈতিক ফোরামের এক সম্মেলনে এমবিএসকে দেখে মনে হয়েছে দেশের ভেতরে তার কোনো রকম সমস্যায় নেই।
অপরদিকে রাশিয়া ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা সাইড-লাইনে থেকে সবকিছু অবলোকন করছে। তারা এই হত্যাকাণ্ডে সৌদি আরবের ভাষ্যকেই বিশ্বাস করে নিতে বলছে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে যে, রাশিয়াও বর্তমানে সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহী।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজেও চান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব এবং ভূমিকা আরও বাড়াতে। সৌদি আরবের পক্ষেও খুব দ্রুত অস্ত্রের জন্যে পশ্চিমা দেশ হতে চীনের দিকে সরে যাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ হলো পশ্চিমা অস্ত্র, প্রশিক্ষক, উপদেষ্টা দিয়েই তারা ইয়েমেনে অভিযান পরিচালনা করে আসছে।
তবে একটি বিষয় হলো সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর মধ্যেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান। যে কারণে তারা যদি একসঙ্গে ব্যবস্থা নিতে না পারেন, সেক্ষেত্রে সৌদি আরবের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনাই আপাতত থাকছে না। অন্তত হোয়াইট হাউসে ক্ষমতার পালাবদল না ঘটা পর্যন্ত তো নয়ই।
সব মিলিয়ে এটি এখন প্রায় পানির মতো পরিষ্কার যে, সৌদি সাংবাদিক খাশোগি হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বদলে দিতে পারে। তবে সময়ই বলে দেবে কি হতে চলেছে।