দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আমরা অনেকেই তাহাজ্জুদের নামাজ সম্পর্কে জানি কিন্তু এর গুরুত্ব এবং ফজিলত সম্পর্কে আমাদের কোনই ধারণা নেই। আজ তাহাজ্জুদের নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জেনে নিন।
তাহাজ্জুদ শব্দটি মূলত নিদ্রা যাওয়া ও জাগ্রত হওয়া পরস্পরবিরোধী দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত রয়েছে- ‘রাত্রির কিছু অংশ কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন’ (সূরা বনি ইসরাইল:৭৯)। কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকার অর্থ হলো নামাজ আদায় করা। সে কারণেই রাত্রিকালীন নামাজকেই তাহাজ্জুদের নামাজ বলা হয়ে থাকে। তবে বেশির ভাগ মুফাসসিরদের মতে, শয্যা পরিত্যাগ করে জিকির এবং দোয়ায় আত্মনিয়োগ করার অর্থই হলো তাহাজ্জুদ ও নফল নামাজ, যা গভীর রাতে ঘুম হতে ওঠার পর পড়া হয়। তাহাজ্জুদ মেরাজের পর সেটি নফল হয়ে যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করো; এটি তোমার জন্য একটি অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় যে, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে’ (সূরা বনি ইসরাইল:৭৯)।
তাহাজ্জুদ নামাজ মন ও চরিত্রকে নির্মল এবং পবিত্র করা ও সত্য পথে অবিচল রাখার জন্য অপরিহার্য এবং অত্যন্ত কার্যকর একটি পন্থা। কুরআনের সূরা মুজাম্মিলে-এর উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে, ‘নিশ্চয়ই রাতে ঘুম হতে ওঠা নফসকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর ও সে সময় কুরআন পাঠ বা জিকির একেবারেই যথাযথ।’ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ হলো সব আম্বিয়াদের সুন্নত, আল্লাহ তায়ালার মাহবুব বান্দাদের অভ্যাস ও আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপন তথা নৈকট্য এবং সন্তোষ অর্জনের অন্যতম একটি পন্থা। তাহাজ্জুদের ফজিলত প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ কায়েম করুন; এটি আপনার জন্য একটি অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় যে, আপনার প্রতিপালক আপনাকে মাকামে মাহমুদ দান করবেন।’
হাদিসের আলোকে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব
তাহাজ্জুদের এই নফল নামাজকে মহানবী (সা:) শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ওপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া হতে বিরত হননি। হজরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততোধিক রাকায়াত নামাজ পড়ে নেয়, সে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী। মাহে রমজানে দিবাভাগে পানাহার বর্জন করে রোজা পালনের পর গভীর রাতের নিদ্রাসুখ ত্যাগ করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের গুরুত্ব এবং ফজিলত রয়েছে অনেক। তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সব নফল ইবাদত অপেক্ষা অধিক ও এটি আল্লাহর কাছে অতি প্রিয় বলে উল্লেখ রয়েছে।
তাহাজ্জুদের সালাতের মহত্ত্ব, মর্যাদা এবং গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটে। রব ও স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অভিপ্রায়ী একজন মুসলমানের কর্তব্যই হলো, সে এই মহান ইবাদতটির মর্যাদা এবং গুরুত্ব অনুধাবন করবেন। এটির যথার্থতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবেন। তাছাড়াও এই সালাতের অনেক লাভ এবং ফজিলত রয়েছে।
তাহাজ্জুদ এবং শেষ রাতে জাগ্রত থাকা অবসাদগ্রস্থতার চিকিৎসা প্রসঙ্গ
বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার একথা দিবালোকের মতো সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, রুগ্ন, অসুস্থ, অর্ধমৃত ও অনিদ্রার রোগীদের নানা রকমের চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্য কল্যাণকর একটি চিকিৎসা রয়েছে।
বলা হয়েছে যে, তারা যদি রাতের শেষ দিকে জেগে কাটায়, তাহলে তাদের দেহ অবশ্যই এর সুফল লাভ করবে। মনস্তত্ত্বের চিকিৎসক ও মস্তিস্ক বিশেষজ্ঞরা এই সম্পর্কে প্রমাণিত কিছু গবেষণার কথাও উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন যে, রমজানে মুসলমানদের মধ্যে ডিপ্রেসন কিংবা অবসাদ রোগ কম দেখা যায়। রমজান মাসে চিকিৎসকের কাছে অবসাদের রুগী খুব কমই আসে। এর কারণ হিসেবে তারা ঊল্লেখ করেন, রমজান মাসে মুসলমানরা রাত্রী শেষে সাহরি খায়, তাহাজ্জুদ আদায় করে, যে কারণে তাদের মধ্যে ক্লান্তি ও অবসাদ দেখা দেয় না। সে কারণে চিকিৎসকরা এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, শেষ রাতে জেগে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি বিষয়।
তাহাজ্জুদের নামাজ নিয়ে লাহোরে আল্লামা ইকবাল মেডিক্যাল কলেজে মনোস্তত্ত্ব ও মস্তিষ্ক বিভাগে নিয়মিত আদায় করার উপর গবেষণার ফলাফল:
১৯৮৫ সালে জানুয়ারি হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লাহোরে আল্লামা ইকবাল মেডিক্যাল কলেজে মনস্তত্ত্ব ও মস্তিষ্ক বিভাগে ৬৪ জন অবসাদগ্রস্ত রোগী মনোনীত করে তাদের ৩২ জন ৩২ জন করে ২ গ্রুপে পৃথক করা হয়। প্রথম গ্রুপ (রিসার্স গ্রুপ ) ৩২ জনকে রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করানো হয়। সেই সঙ্গে জিকির ও কুরআন তিলাওয়াত এবং (ক) ‘আলা বিজিকরিল্লাহি তাৎমাইননুল কুলুব’ (খ) ‘ওয়া ইয়া মারিদতু ফাহুয়া ইয়াশ ফিল’ মনে মনে পাঠ করতেও বলেন। দ্বিতীয় দল (কন্ট্রোল গ্রুপ) তারা রাত ২টা হতে ৪টা পর্যন্ত জাগবে ছোট ছোট কাজ করবে এবং কুরআন তিলাওয়াত করবে।
বলা হয়েছে, যে সকল রোগী দীর্ঘদিন হতে অবসাদগ্রস্ত ওষুধ সেবন করতো তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৪ সপ্তাহ পর হেমিলটন ডিপ্রেশন স্কেল দিয়ে পরীক্ষাও করা হয়। দেখা যায় যে, প্রথম গ্রুপ (রিসার্স গ্রুপ) যারা তাহাজ্জুদ আদায়সহ কুরআন তিলাওয়াত করেছে তাদের অবস্থা দ্বিতীয় গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। এভাবে জানুয়ারি হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিয়মিত অনুসরণ করার কারণে প্রথম গ্রুপ (রিসার্স গ্রুপ) হতে ২৫ জন রোগী দ্বিতীয় গ্রুপ (কন্ট্রোল গ্রুপ) হতে ৫ জন রোগী আরোগ্য লাভ করেছেন বলে জানা যায়।
গবেষণা করে দেখা যায় যে, তাহাজ্জুদের নামাজ একজন মুসলমানের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি বিষয়। তাই তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করুন এবং এর ফজিলত লাভ করুন।