দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ সংস্থা (নাসা)’র কাছে দেওয়া একটি অভিযোগ কেন্দ্র করে প্রশ্নটি সামনে এসেছে। সেখানে মার্কিন মহাকাশচারী অ্যানি ম্যাক্লেইনের বিরুদ্ধে তাঁর সাবেক জীবনসঙ্গী সামার ওর্ডেন অভিযোগ করেছেন।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, তার অভিযোগ হলো অ্যানি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS)-এ অবস্থান করার সময় শক্তিশালী কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মহাশূন্য হতে ওর্ডেনের ব্যাংক একাউন্টে অনধিকার প্রবেশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়- ওর্ডেনের ব্যাংক লেনদেনে গোপনে নজরদারিও করেছেন! অভিযোগ পাওয়ার পর মহাকাশে ঘটা প্রথম ‘অপরাধ’-এর তদন্ত ইতিমধ্যে শুরু করেছে নাসা।
পৃথিবীর ভূমিতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীকে গ্রেফতার করার জন্য প্রত্যেক দেশে পুলিশ রয়েছে, বিচারের জন্য ফৌজদারি আইন ও আদালতও রয়েছে। তবে মহাকাশে কেও অপরাধ করলে সেক্ষেত্রে কোনো আইন ও আদালতে বিচার হবে- এই প্রশ্নের উত্তর মোটেই সরল হয়নি। প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী মহাসাগরের মতো মহাকাশ ও ‘Res Communis. অর্থাৎ পৃথিবীর সবার মালিকানাধীন কিংবা কারও একক মালিকানাধীন নয়- কোনো দেশ এই মহাকাশ কিংবা মহাকাশস্থিত চাঁদ-সূর্য বা কোনো গ্রহ-নক্ষত্রের একক মালিকানার দাবিদার হওয়ার কথা নয়।
তবে মহাকাশে অভিযান পরিচালনা, মহাকাশযানের মালিকানা ও মহাকাশযানের অভ্যন্তরে নভোচারীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫টি আন্তর্জাতিক চুক্তি বলবৎ রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৬৭ সালের ‘Outer Space Treaty.’ এই চুক্তি অনুসারে কোনো মহাকাশযানের ভেতরে কোনো নভোচারী দ্বারা সত্যিই যদি অপরাধ সংঘটিত হয় তাহলে সেই মহাকাশযানের মালিকানা যে দেশের সেই দেশ ওই অপরাধের বিচার করার ক্ষেত্রে এখতিয়ার রাখবে। বলাবাহুল্য মহাকাশে যেহেতু কোনো পুলিশ কিংবা আদালত নেই তাই নভোচারী পৃথিবীতে ফেরত আসার পরই তার বিচার শুরু হবে। বিষয়টা ঘোঁট পাকাবে যদি মহাকাশযানের মালিকানার দেশ ও নভোচারীর দেশ ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন একটি মার্কিন মহাকাশযানে একজন অস্ট্রেলিয়ান নভোচারী কোনো অপরাধ করলো ও অস্ট্রেলিয়া নিজের নাগরিকের বিচার নিজ দেশে করতে চাইছে। বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন অপরাধটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন -এ সংঘটিত হয়। কারণ হলো এটি একক কোনো দেশের মালিকানা নেই। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS)-এর মালিকানা ৫টি দেশের- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপ, জাপান ও ক্যানাডা।
এখানে ইউরোপকে একটি দেশ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। মহাকাশ স্টেশন পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে ১৯৯৮ সালে এই ৫টি দেশের মধ্যে যে আন্তঃসরকার চুক্তি হয় সেখানে বলা রয়েছে- আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, এর যন্ত্রপাতি ও এই স্টেশনে অবস্থান করা নভোচারীদের ওপর এই দেশগুলোর নিজস্ব আইন নভোচারীদের জাতীয়তার ভিত্তিতে কার্যকর করা হবে। সুতরাং, কোনো ক্যানাডিয়ান নাগরিক যদি মহাকাশ স্টেশনে গিয়ে অপরাধ ঘটিয়ে থাকে, তাহলে তিনি ক্যানাডিয়ান ফৌজদারি আইনের আওতাতে পড়বেন। একইভাবে রুশ নভোচারীরা রাশিয়ার আইনের অধীনেই থাকবেন। এটি পুরোপুরি স্পষ্ট যে, উপরে উল্লেখিত ঘটনায় অভিযুক্ত অ্যানি ম্যাক্লেইন ও অভিযোগকারী সামার ওর্ডেন দুজনেই যেহেতু মার্কিন নাগরিক তাই এই ঘটনার বিচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজদারি আইনেই হবে। যদি দুজনের একজন ভিন্ন দেশের নাগরিক হতো সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের দেশে বিচারে আগ্রহী না হলে অপর দেশের ফৌজদারি আইনটি প্রযোজ্য হতো।
মুশকিল হলো, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের বিভিন্ন পার্ট কিংবা মডিউলের মালিক ভিন্ন ভিন্ন ৫টি দেশ। এখন নভোচারীদের দেশ ও স্টেশনের যে পার্টে অপরাধ সংঘটিত হলো সেই পার্টের মালিকানা যদি ভিন্ন কোনো দেশের হয়ে থাকে তাহলে কোন দেশের আইন প্রযোজ্য হবে? সেটি একটি প্রশ্ন। উদাহরণস্বরূপ ‘ক’ নামের নভোচারী ‘ক’ নামক দেশের নাগরিক। সে ‘খ’ দেশের ‘খ’ নামের আরেক নভোচারীর মোবাইল চুরি করলো মহাকাশ স্টেশনের এমন একটি অংশ হতে যেটির মালিকানা মূলত ‘গ’ দেশের। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে, পার্টনার দেশগুলো পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে কোনো নভোচারী যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করে সেক্ষেত্রে তার বিচার আসলে কোন দেশে হবে? সমস্যা আরও রয়েছে- পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের ভূখণ্ড নির্ধারিত তবে মহাকাশে তো আর কোনো বাউন্ডারি নেই। তাহলে আকাশের ঠিক কোন উচ্চতা থেকে মহাকাশ বা স্পেস- জুরিসডিকশান শুরু হবে- সেই প্রশ্নেও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
মহাকাশ হতে পৃথিবীর কারো ব্যাংক একাউন্টে বেআইনি অনুপ্রবেশ মহাকাশে সংঘটিত প্রথম অপরাধ ও প্রকৃতি বিবেচনায় হয়তো খুব গুরুতর অপরাধ হবে না। তবে সেটি আরও গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রশ্নের দরোজা খুলে দিয়েছে তা হলো- মহাকাশে কেও খুন, ধর্ষণ, আকাশ-দস্যুতা বা মানবাধিকার লংঘনের মতো অপরাধ করলে তার কী হবে? অথবা মহাকাশে বসে পৃথিবীতে অপরাধ পরিচালনা করলে এটির আইনি পরিণতিই বা কী? এখনও হয়তো মহাকাশে বিচরণ নাসা ও মহাকাশ স্টেশনের গুটিকয়েক নভোচারীদের মধ্যেই সীমিত রয়েছে। তবে মহাকাশ পর্যটন বা স্পেস ট্যুরিজম এর সম্ভাবনাও দিন দিন আরও উজ্জ্বলতর হচ্ছে।