দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ জয়কুমার বৈদ্যের জীবনে এমনও সময় গেছে, যখন সে স্কুলের মাইনে না দিতে পারার জন্য পরীক্ষার রেজাল্টও আটকে দেওয়া হয়েছে! তার মা বহু কষ্ট করে অর্থ জোগাড় করে পড়াশোনা চালানোর চেষ্টা করেছেন। বস্তির সেই ছেলেটি বর্তমানে ভার্জিনিয়ার একজন সফল বিজ্ঞানী!
জীবনের শুরুতে যখন তার এমন করুণ অবস্থা অনেকেই সেই সময় তার মাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ছেলেকে পড়াশোনা না করিয়ে ড্রাইভারের চাকরিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে জয়কুমার বা তার মা সেই সব কথায় কখনও কান দেননি।
তাইতো আজ জয়কুমার আমেরিকার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সফল বিজ্ঞানী। তবে মুম্বাইয়ের বস্তিতে থাকার অভিজ্ঞতা কোনও দিনও ভুলতে পারবেন না জয়কুমার। সেই দরিদ্র ছেলে এই মুহূর্তে ন্যানো টেকনলজি‚ ন্যানো অক্সিলেটর ও ন্যানোস্কেল ডিভাইজ অ্যাপ্লিকেশন এবং আর্কিটেকচার নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, জীবনে সফল হওয়ার স্বপ্ন জয়কুমার দেখেছিলেন মুম্বাইয়ের কুর্লা অঞ্চলের বস্তির একটা ৮ বাই ১০ স্কোয়ার ফিটের বাড়িতে বসেই। তবে এই গল্পের সত্যিকারের ‘হিরো’ হলেন তারই মা নলিনী। শ্বশুরবাড়ি হতে নলিনীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। পরে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদও হয়ে যায়। ছোট ছেলেকে নিয়ে নলিনী তার মায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নলিনীর মা ছিলেন অফিসের এক জন কেরানি। কোনও রকমে সংসার চলছিলো তাদের। তবে ২০০৩ সালে অসুস্থ হওয়ার কারণে চাকরি যায় তার। যে কারণে ময়দানে নামতে হয় নলিনীকে।
তিনি ছোটখাটো কাজ করে কোনও রকমে সংসার চালাতেন। অন্যদিকে নিয়মিতভাবে নলিনীকে আদালতেও ছোটাছুটি করতে হতো বিবাহ বিচ্ছদের মামলা লড়ার জন্য। এইভাবে ৫ বছর কেটে যায়। এমনও সময় গেছে যখন জয়কুমার শুধুমাত্র বাসি পচা বড়াপাও‚ সিঙারা‚ পাউঁরুটি ও চা খেয়ে দিন কাটিয়েছেন।
বহু বছর কষ্ট করার পর অবশেষে স্থানীয় এক মন্দির জয়কুমার ও নলিনীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলো। মন্দির ট্রাস্টের দয়াতেই স্কুল ও কলেজ পাশ করেন জয়কুমার। অনেকেই হয়তো ভাবছেন ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন কী করে দেখলেন এই জয়কুমার? জয়কুমার একবার এক বন্ধুর বাড়িতে ডিসকভারি চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠান দেখেন। দেখেন মহাকাশ সম্পর্কিত একটি সিনেমা। সেই দিনই বিজ্ঞানী হওয়ার বীজ রোপণ হয় তার মধ্যেও। তাছাড়াও জয়কুমারের মনে হয়েছে যখন গ্রহণ হতো তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা বিজ্ঞানসম্মত উত্তর না দিয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর ঝুঁকতো বেশি। জয়কুমার এই সবে বিশ্বাস না করে বিজ্ঞানসম্মত উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ঠিক তখনই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন জয়কুমার।
ছেলের পড়াশোনার প্রতি এতো আগ্রহ দেখে নলিনী জয়কুমারকে উৎসাহ দিতেন। এই সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে জয়কুমার বলেন, ‘একমাত্র মা আমাকে সারা জীবন উৎসাহ দিয়ে গেছেন। মায়ের কারণে আমি কখনও হার মানিনি। অনেকবার মনে হয়েছে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। তাতে এক জনের অন্তত খাওয়ার খরচ বাঁচতো। তবে মায়ের কথা ভেবে তা আমি পারিনি। মা আমার জন্য প্রেরণা। মায়ের জন্য আমি সফল হতে চাই ও অন্যদের সাহায্য করতে চাই।’ আগামী দু’বছরে তিনি তার মাকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চান।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় জয়কুমার একটা টিভি মেরামতের দোকানে কাজ নিয়েছিলেনস। তাছাড়াও কুর্লা অঞ্চলের একটা কাপড়ের দোকানেও কাজ করতেন তিনি। মাসে মাত্র ৪ হাজার টাকা রোজগার ছিল তার। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় রোবোটিক্সে তিনি ৩টি জাতীয় এবং ৪টি রাজ্য স্তরে পুরস্কারও জেতেন। যে কারণে তিনি লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোতে একটা ইনটার্নসিপের সুযোগ পেয়ে যান। স্নাতোক হওয়ার পরই জয়কুমার টাটা ইনস্টিউট-এ রিসার্চ করার সুযোগ পেয়ে যান। তখন তার মাসিক আয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার টাকা। জয়কুমার তা দিয়ে বাড়ি মেরামত করেন এবং মাকে একটা এয়ারকন্ডিশনও কিনে দেন।
গত তিন বছর ধরে আমেরিকায় রয়েছেন জয়কুমার। ইতিমধ্যেই তার দু’টো গবেষণাপত্র নামকরা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। জয়কুমার চান ভবিষ্যতে ভারত, হার্ডওয়্যার টেকনোলজিতে আরও আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠুক ।
বর্তমানে জয়কুমার যতো টাকা বৃত্তি পান। তারমধ্যে নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে বাকিটা সবই মাকে পাঠিয়ে দেন। ‘আমার গবেষণা শেষ হয়ে গেলে কিছুদিন আমি চাকরি করতে চাই। তারপর দেশে ফিরে গিয়ে নিজের কারখানা খোলার ইচ্ছা রয়েছে। আর আমি চাই মেধাবী ও দুঃস্থ বাচ্চাদের সাহায্য করতে।’ আপাতত এই স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে চলেছেন জয়কুমার।