দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে দণ্ডিত বাংলাদেশী যুবক রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের সাজা কমানোর জন্য বেসরকারি পথ অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে বাংলাদেশী যুবক রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের ৩০ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার পর তার সাজা মওকুফ, সাজার মেয়াদ কমানো কিংবা তাকে দেশের কারাগারে সাজা খাটানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক এমনি দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাজাপ্রাপ্ত নাগরিকদের ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে এমন উদাহরণ তুলে ধরেও এ যুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু বিষয়টি কতটা সম্ভব? যারা এ কথা বলছেন তারাই বা কতটা যুক্তিনির্ভর দাবি তুলছেন? এ কথা জানতে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করা হলে এ ব্যাপারে মিশ্র বক্তব্য পাওয়া গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে এমন একটি উদ্যোগের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই জানিয়েছেন তারা। বেসরকারিভাবে এমন একটি উদ্যোগ হতে পারে এমনটা মনে করলেও এসব উদ্যোগের ফল খুব একটা ইতিবাচক হবে না বলেই ধারণা তাদের।
বিষয়টি নিয়ে সঙ্গে কথা হয় জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে। পড়াশোনা, অধ্যাপনা ও পেশাগত কারণে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস এবং কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ড. মোমেন বলেন, সরকারের পক্ষে এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া অসম্ভব। কোনে দেশ যখন তার নিজস্ব আইনের অধীনে কারো বিচার করে সাজা দেয় তখন অন্য দেশের সরকার সেই সাজা বাতিল বা কমানোর দাবি তুলতে পারে না।
অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করলে ড. মোমেন বলেন, সেগুলো সবই হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের জ্বালানি মন্ত্রী বিল রিচার্ডসন বাংলাদেশ থেকেও তাদের একজন বন্দিকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছেন। তবে সেটি তিনি মন্ত্রী হিসেবে নয় যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নেতা হিসেবে।
বিল রিচার্ডসন ছাড়াও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, কৃষ্ণাঙ্গ নেতা জেসি জ্যাকসন বিভিন্ন সময়ে তাদের নাগরিকদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুক্ত করে এনেছেন।
১৯৯৬ সালে মার্কিন তরুণী এলিয়াডাকে বাংলাদেশ থেকে মুক্ত করে আনেন বিল রিচার্ডসন। এলিয়াডা ততদিনে বাংলাদেশে সাড়ে চার বছর জেল খেটেছে। ১৮ বছর বয়সে মাদক পাচার করতে গিয়ে আটক হয় সে। রিচার্ডসন সেবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘১৮ বছর বয়সে মেয়েটি একটি ভুল করেছে। মাদক পাচার চক্রের হাতে পড়ে সে এই কাজে নেমেছে। তাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায়।’
রিচার্ডসনের উপস্থিতিই ছিলো এলিয়াডার মুক্তির কারণ। তবে বিল রিচার্ডসনের এই দূতিয়ালী যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে নয়, এ ছিলো একান্তই তার নিজের একটি উদ্যোগ। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতার কারণেই তিনি সেটা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেই তাদের নাগরিকদের ছাড়িয়ে এনেছেন। সবশেষ উত্তর কোরিয়ায় আটক ক্রিশ্চিয়ান মিশনারী কোরীয়-আমেরিকান কেনেথ বায়েকে ছাড়িয়ে আনার লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া আমেরিকার প্রখ্যাত নাগরিক অধিকার নেতা জেসি জ্যাকসনের দূতিয়ালিতে ২০১২ সালে গাম্বিয়া থেকে মুক্ত হয়ে দেশে এসেছেন দুই আমেরিকান নাগরিক। এরা হচ্ছে আমাদুও জান্নেহ ও তামসির জাসেহ। দুজনই গাম্বীয় বংশোদ্ভূত এবং যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করে এখানকার নাগরিকত্ব পান। বিষয়টি নিয়ে গাম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি ইয়াভা জাম্মেহ’র সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলেন জেসি জ্যাকসন। এর ভিত্তিতেই ওই দুই নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হয়।
আমাদুও জান্নেহর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজ দেশে গিয়ে তিনি সরকার বিরোধী ‘স্বৈরাচারি বন্ধ করো’ এমন স্লোগান দিয়ে টি-শার্ট ছাপিয়েছিলেন। এ কারণে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো। ১৫ মাস জেলে কাটানোর পর জেসি জ্যাকসনের মধ্যস্থতায় তার মুক্তি হয়।
জাসেহর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, সরকার বিরোধী একজন নেতাকে গাড়ি চালিয়ে সেনেগালের সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে। তাকেও ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো যার ৬ বছর সাজা খেটে তিনি মুক্তি পান।
ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমরা দেখেছি উদ্যোগগুলোর কোনোটিই সরকারি পর্যায়ের ছিলো না। জিমি কার্টার, বিল রিচার্ডসন কিংবা জেসি জ্যাকসন এরা সকলেই তাদের নিজ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বিশ্বের কাছে তাদের একটি সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ফলে তাদের দূতিয়ালিতে মুক্তি দেওয়া ছিলো দেশগুলোর রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের সম্মানবোধের পরিচয়।’
বাংলাদেশ থেকে এমন উদ্যোগ কে নিতে পারেন সে কথা জানতে চাইলে, ড. মোমেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা ব্র্যাকের প্রধান স্যার ফজলে হাসান আবেদের নাম উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এরা দু’জনই আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন। তাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলে তা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে নাগরিকদের ছাড়িয়ে এনেছেন তাদের অপরাধগুলো ছিলো সাধারণ মাত্রার। বিশ্বের দেশে দেশে এমন আরও ঘটনা ঘটে। অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় নাফিসকে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো মুক্তি দেবে না, কিংবা সাজার মেয়াদও কমাবে না বলেই মনে করেন ভয়েস অব আমেরিকার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি জাকিয়া খান। তিনি বলেন, ‘ক্ষমারও একটি যোগ্যতা-অযোগ্যতা রয়েছে।’
দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্র বসবাসের ও সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতার আলোকে জাকিয়া খান বলেন, ‘এখানে কোনো অপরাধের সঙ্গে যখন ছাত্ররা সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন তা অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নেয় সরকার। নাফিসকে এ কারণেই দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ছাত্র-ছাত্রী এমন অপরাধে নিজেকে সম্পৃক্ত না করে।’
তবে নাফিসের ক্ষেত্রে একটি মানবিক দিকও রয়েছে, এই কথা উল্লেখ করে জাকিয়া খান বলেন, ‘ছোট্ট একটি ছেলেকে এমন একটি অপরাধের দিকে টেনে আনা হয়েছে। সেই আলোকেই তার সাজা কিছুটা কমানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’
এই সাংবাদিকও মনে করেন উদ্যোগটি সরকারি নয়, বেসরকারি পর্যায়েই হতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা উল্লেখ করেন তিনিও। বলেন, ‘তার যুক্তরাষ্ট্রে একটি বড় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এদেশের সর্বোচ্চ সম্মানের দু’টি পদকই তিনি পেয়েছেন। যা বিরল একটি ঘটনা।’
তবে বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টিতে উদ্বিগ্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখার নির্দেশনাও রয়েছে। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলাম বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর সন্ত্রাসবাদের একটি তকমা এঁটে দেওয়া হয়েছে। সরকার সর্বতোভাবেই চেয়েছিলো যাতে নাফিসকে নির্দোষ প্রমাণ করা যায়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনো ভাবেই নাফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আর সে নিজেই দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় সরকারের পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি। নাফিসের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের চেষ্টা করেও তা পারা যায়নি বলে জানান মনিরুল ইসলাম। নতুন করে যোগাযোগ স্থাপনে তিনি কাজ শুরু করেছেন জানিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, সরকার বিষয়টির এখনই ইতি টেনে দিচ্ছে না।
সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এমন উদ্যোগ থাকলে একটা ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কমিউনিটির কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় কাউন্সিল মেম্বার ড্যানিয়েল ড্রম। তিনি বলেন, ‘স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে তরুণদের এমন ফাঁদে ফেলার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এবং এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। বাংলাদেশ থেকে এমন উদ্যোগ থাকলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার আন্দোলনের সহযোগিতা থাকবে বলেও মনে করেন ড্যানিয়েল ড্রম। তিনি বলেন, মামলাটির বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তার জানা নেই। তবে ইসলামকে ও মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার যে চেষ্টা চলছে তার সঙ্গে তিনি একমত নন।
তবে কথা যতই হোক। একটি জিনিস সকলের কাছেই ক্লিয়ার আর তা হলো, বাংলাদেশী যুবকের সাজা হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে সাজা হলে তা পুরোপুরি খেটে বের হতে হয় তাও সকলেরই জানা। আর তাই সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক নাফিসের বিষয়ে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এমন একটি যুবকের ভবিষ্যৎ চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যাবে- সেটি কারো কাছেই কাম্য নয়। মানুষ মাত্রই ভুল করে- তবে সে ভুল শুধরাবার সুযোগ দেওয়া উচিত। তথ্যসূত্র: আমাদের সময় অনলাইন।