দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ জনগণের অধিকার আদায় করতে হরতাল এ কথাটি এখন আর মনে করেন না ফল বিক্রেতা খবির। তিনি আগুনে দগ্ধ হয়ে বলেছেন, ‘হরতাল শুধু আমাকে নয় আমার পুরো পরিবারের ভবিষ্যতও পুড়িয়ে মারলো’।
ফুটপথে ফল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে খবির উদ্দিন (৪০)। ডেমরা মুক্তি সরণির রায়েরবাগের ফুটপাতে বসে ফল বিক্রি করতেন তিনি। প্রতিদিন ফুটপাতে ফল বিক্রি করে যা আয় করেন তা দিয়ে চলে তার সংসার। সারাদিন বেচা-বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে তিনি চাল-ডাল, নুন-তেল কিনে বাড়ি ফেরেন। বাসায় ফেরার পরই স্ত্রী ও সন্তানদের মুখে খাওয়া ওঠে। যেদিন ফল বিক্রি করতে পারে না, সেদিন আর বাসায় চুলা জ্বলে না। উপস থাকতে হয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। এমন দিন আনা- দিন খাওয়া একজন খবির উদ্দিন। কিন্তু হরতালের এই নির্মম সহিংসতা কেড়ে নিয়েছে সেই একটু বেঁচে থাকার অধিকার টুকুও! এখন তিনি ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কতদিনে তিনি সুস্থ্য হবেন তাও জানেন না। আর এ সময় তার ৩ মেয়ে ও স্ত্রীর কি খাবে, কিভাবে চলবে তা নিয়ে রিতিমতো শঙ্কিত তিনি। কি অধিকারে, কার অধিকারে এ হরতাল সে চিন্তায় তিনি শুধুই তাল-গোল পাকিয়ে ফেলছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় খবির উদ্দিন বার বার এমন প্রশ্নই করেছেন।
হরতাল চলাকালে গত মঙ্গলবার রাজধানীর রায়েরবাগে বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সেখানে দগ্ধ ৯ যাত্রীর মধ্যে খবির উদ্দিনও একজন। আগুনে তার মুখমন্ডল ও শরীর ঝলসে গিয়েছে। তিনি ওইদিন ফল বিক্রি করে বেলা ২টার দিকে কোমল পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। সিটে বসার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ যাত্রীরা ‘আগুন, আগুন’ বলে চিৎকার করে ওঠে। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বাসটিতে । এসময় খবির উদ্দিন ও ইডেন কলেজ ছাত্রী রাবেয়া সুলতানাসহ ৯ বাসযাত্রী দগ্ধ হন।
ওই ঘটনায় পুড়ে গেছে আবুল কালাম আজাদের ২৫, তারেক আহমেদের ২৩, আবদুল মান্নানের ১৯, নূর মোহাম্মদ শুভর ১৫, রাবেয়া আক্তারের ১১, আবদুল হাইয়ের ১০, খবির উদ্দিনের ১০, ও আবু বক্কর সিদ্দিকের ৮ শতাংশ। তারা সবাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বার্ন ইউনিটে বসে কথা বলার সময় খবিরের শয্যার পাশে বসে ছিলেন তার স্ত্রী তানিয়া ও ১৪ মাসের শিশু কন্যা মরিয়ম। কথা বলতে বলতে এক সময় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খবির চিৎকার করে বলে উঠেন, ‘মারে, তোদের এখন কি অবস্থা হবে!’ খবিরের এমন আহাজারিতে ওয়ার্ডের অন্যরাও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। দর্শনার্থীদের অনেকেই এ সময় বলেন, এসব দৃশ্য কি বিরোধী দল ও সরকারি দলের লোকজনের চোখে পড়ছে না? তারা কি শুধুই জনগণকে এভাবে গিনিপিক বানিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা ও ক্ষমতায় যাবার জন্য যুদ্ধ চালাবে?
এসব প্রশ্নের জবাব হয়তো কেওই দিতে পারবে না। কিন্তু যখন আমরা পত্রিকা ও টিভিতে এমন সব বিভৎস্য দৃশ্য দেখি তখন আমরা আর নিজেদের ধরে রাখতে পারি না। সভ্য সমাজের মানুষ হিসেবে কি আমাদের কোনই দায়িত্ব নেই? কেনো আজ আমাদের এই রকম অমানবিক দৃশ্য দেখতে হচ্ছে? জবাব দেওয়ার কেও নেই। সেই পুরনো শব্দ ‘বিচারের বাণী নিরবে নীভৃতে কাঁদে’, এদেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা অর্থাৎ পুরো জাতির অবস্থা এখন অনেকটা সেরকম। এদেশের মানুষ একাত্তরে যুদ্ধ করে যে স্বাধীন দেশ পেয়েছিল সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আজ জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত কোন না কোনও ভাবে। কিন্তু আর কতদিন। এর একটা শেষ হওয়া দরকার। বিবেকবান প্রতিটি মানুষের কাছে সেই আর্তি এদেশের ১৬ কোটি মানুষের।