সবাই শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু আজও চাকরি জাতীয়করণ হয়নি বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারি এবং বিরোধী দলে যারা আছেন, তারা সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সবাই তা ভুলে গেছেন। দেশ গড়ার কারিগর যারা তারা বারংবার রাজপথে নেমেছেন তাদের দাবি আদায়ের জন্য। তাদের এই দুর্গতির প্রতি কি কোনই মানবিকতা নেই? এমন অনেক প্রশ্নই দানা বেঁধে ওঠে এসব অবহেলিত শিক্ষক ও তাদের পরিবার পরিজনদের।

এদেশ একদিন স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে চলতে পারবে দেশের আপামর সাধারণ মানুষ এটিই সবার ধারণা ছিল। কিন্তু তা কি হতে পেরেছে? এখনও কেনো মানুষ এতো বঞ্ছনার শিকার হবে? কেনোই বা অপদস্ত হতে হবে একজন শিক্ষককে? পত্র-পত্রিকার পাতাতে সেদিন যে দৃশ্য আমরা দেখলাম। শাহবাগে শিক্ষকদের উপর যে পুলিশী তান্ডব চালানো হলো, তা এই সভ্য সমাজের কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না। শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর এই কথাটি হয়তো সেদিন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ভুলে গিয়েছিলেন।

বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় হলো। কিন্তু তা পূরণ হয়নি। মাত্র ৫শ’ কোটি টাকার জন্য আটকে আছে এসব শিক্ষকের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে এ সময়ে অনেক শিক্ষক আহত হয়েছেন। এমনকি জীবনও দিয়েছেন। সর্বশেষ চলমান শিক্ষক আন্দোলনেও শিক্ষক আজিজুর রহমান প্রাণ দিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন শুরু হয় ১৯৯১ সালে। ১৯৯৭ সালে তাদের এ আন্দোলন পরিণতির দিকে যায়। তখন ঢাকার ওসমানী উদ্যানে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি জাতীয়করণের একদফা দাবি আদায়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। কর্মসূচির নবম দিনে বিগত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া কর্মসূচিস্থলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এসময় তিনি তার দল ক্ষমতায় গেলে দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর ২০০০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ওসমানী উদ্যানে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আয়োজন করে শিক্ষক মহাসমাবেশ। ওই মহাসমাবেশেও খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। তখনও তিনি শিক্ষকদের দাবি বিএনপির ১৯ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরও চাকরি জাতীয়করণ হয়নি। তখন ওই সরকারের সর্বশেষ বাজেট সামনে রেখে সব শিক্ষক সংগঠন আন্দোলনে নেমেছিল। তবে চাকরি জাতীয়করণের প্রধান দাবি পূরণ না হলেও ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, প্রধান শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল প্রদানসহ কিছু দাবি মেনে নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী শিক্ষকদের মধ্যে ৭০ ভাগ বেতনপ্রাপ্তরা ৮০ ভাগ, ৮০ ভাগ বেতনপ্রাপ্তরা ৯০ ভাগ এবং ৯০ ভাগ বেতনপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ৯৫ ভাগ পাচ্ছেন। এছাড়া বাড়ি ভাড়া ২শ’ টাকা ও মেডিকেল ভাতা ২শ’ টাকা পাচ্ছেন। বর্তমান মহাজোট সরকারও তাদের বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে এসব শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে এরাও শিক্ষকদের ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে বারবার। শিক্ষক নেতারা জানান, বর্তমান সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে- মানে হল, সরকার ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সার-সংক্ষেপ তৈরির পাশাপাশি ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর ২০১১ সালের নভেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী জানিয়ে দেন, শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই। এরপরই শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন। গত বছর ২১ থেকে ২৭ ডিসেম্বর একইভাবে তারা অনশন করেন। কিন্তু দাবি আদায় হয়নি। উপরন্তু আইয়ুব আলী নামে লক্ষ্মীপুরের এক শিক্ষক অনশন শেষে অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে মারা যান। এরপর ফের আন্দোলনে নামেন তারা। চলতি বছরের ১৫ থেকে ১৯ জানুয়ারি ধর্মঘট ও কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে স্কুলগুলো অচল করে দেন। এভাবে আন্দোলন বর্তমানে শহীদ মিনার পর্যন্ত গড়ায়।

এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অবশ্য চাকরি জাতীয়করণে একদফা উদ্যোগ নিয়েছিল। এ নিয়ে তৈরিকৃত সার-সংক্ষেপে দেখা যায়, সারাদেশে এ ধরনের স্কুল রয়েছে ২৫ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ৯৬ হাজার শিক্ষক। এর মধ্যে অবশ্য মাত্র ৮০ হাজার শিক্ষকের আংশিকসহ বিভিন্ন হারে বেতন দেয় সরকার। সরকারি চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী ২২ হাজার বিদ্যালয়ের ৮০ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের কথা। এর বাইরে আরও সাড়ে ৭ হাজার ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, ৩ হাজার অনিবন্ধিত বিদ্যালয় এবং ২ হাজার কমিউনিটি বিদ্যালয় রয়েছে- যেগুলো সরকারিকরণের তালিকায় ছিল না।

সারাদেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলিয়ে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি। বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান করে আসছেন প্রায় ১ লাখ শিক্ষক। এদের মধ্যে সরকারের থেকে বিভিন্ন হারে বেতন-ভাতা পেয়ে আসছেন ২২ হাজার স্কুলের শিক্ষক।

জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতার জন্য বর্তমানে সরকারের বছরে প্রায় ৫৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। আর ৮০ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ হলে ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব (বিদায়ী) একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, শিক্ষকদের সঙ্গে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বসবেন। সেখান থেকেই শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা দেয়া হবে। তিনি বলেন, ২৫ হাজার স্কুলে লক্ষাধিক শিক্ষক রয়েছেন। তাদের চাকরি জাতীয়করণে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এ কারণে অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে হচ্ছে।

Related Post

আন্দোলনকারী শিক্ষকদের নেতা ও ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব আবদুর রহমান বাচ্চু জানান, চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে তাদের দুই শিক্ষক শহীদ হয়েছেন। এ অবস্থায় তাদের পেছনে ফেরার আর কোন সুযোগ নেই। তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে চেয়ে আছেন। তারা আসন্ন বাজেটে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা দাবি করছেন।

কি আলোচনা হবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তা আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের ধারণা প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা করবেন। কারণ শিক্ষকরাই দেশ গড়ার কারিগর। তাদের অপমান-অপদস্তের হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

স্টাফ রিপোর্টার

View Comments

Recent Posts

রজঃনিবৃত্তির সময় আসার পূর্ব থেকেই মেয়েদের প্রস্তুত থাকতে হবে যেভাবে

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ যুগ যুগ ধরে সব মহিলার ক্ষেত্রেই তো একই রকম ঘটনা…

% দিন আগে

এনার্জিপ্যাক কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্যে অগ্রাধিকার: ‘বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪’ পালন

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের এবারের স্লোগান ‘পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর…

% দিন আগে

বেসিস নির্বাচন ২০২৪: ‘ওয়ান টিম’কে সমর্থনের আহ্বান

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বেসিস নির্বাচনের শেষপ্রান্তে এসে এবারের বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিম তাদেরকে…

% দিন আগে

‘স্টারডম’ নিয়ে ব্যস্ত শাহরুখপুত্র

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খান ‘স্টারডম’ নামে ওয়েব…

% দিন আগে

যুদ্ধ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কোনো চুক্তিতেই যাবে না হামাস

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরায়েলের গণহত্যা এবং আগ্রাসন পুরোপুরি বন্ধ…

% দিন আগে

চার তলা থেকে পড়ে দোতলার কার্নিশে আটকে বেঁচে গেলো এক শিশু! [ভিডিও]

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ‌‌"রাখে আল্লাহ মারে কে' কথাটি আবারও প্রমাণ হলো। ঘটনাটি ঘটেছে…

% দিন আগে