ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দেশের খ্যাতিমান লেখক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই। দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বেলভ্যু হাসপাতালে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ঃ রাজিউন)
তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। টিভি চ্যানেলগুলো নিয়মিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে হুমায়ূন আহমেদের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করতে থাকে। হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ নেওয়া সাক্ষাৎকার দেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করতে থাকে। টিভি চ্যানেলগুলোতে কবি, সাহিত্যিক এবং শুভান্যুধায়ীরা এসে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণ করেন।
নন্দিত এই লেখকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলায় জন্ম হয়েছিল তার। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছোটভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বন্ধু মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ড. মোমেনও মৃত্যুর সময় হাসপাতালে ছিলেন।
ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পর একুশে পদকজয়ী হুমায়ূনকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের উপদেষ্টা নিয়োগ করে সরকার। হুমায়ূন যে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন, তা ১৮ জুলাই চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন। অবশেষে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
উল্লেখ্য, বৃহদান্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে যান হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন তিনি। দুই পর্বে মোট ১২টি কেমো থেরাপি নেয়ার পর ১২ জুন বেলভ্যু হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান ডা. জেইন এবং ক্যান্সার সার্জন জজ মিলারের নেতৃত্বে হুমায়ূন আহমেদের দেহে অস্ত্রোপচার হয়।
অস্ত্রোপচারের পর ১৯ জুন বাসায় ফিরেছিলেন এই লেখক। স্ত্রী শাওনসহ সন্তানদের নিয়ে কুইন্সে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকছিলেন তিনি। বাসায় ফিরলেও অবস্থার অবনতি ঘটলে পুনরায় বেলভ্যু হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। ২১ জুন তার দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার হয়। এরপর গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। অস্ত্রোপচারের আগে পরিবার-আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ১১ মে দেশে আসেন হুমায়ূন। দেশে ২০ দিন অবস্থানের পুরোটা সময় গাজীপুরে নিজের গড়া নুহাশ পল্লীতে কাটিয়েছিলেন তিনি।
ফিরে দেখা
১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া হুমায়ূন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই লেখালেখি শুরু করে সাহিত্য সমালোচকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। নন্দিত নরকে তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। এরপর শঙ্খনীল কারাগার, রজনী, এপিটাফ, পাখি আমার একলা পাখি, ফেরা, নিষাদ, দারুচিনি দ্বীপ, নির্বাসন, অমানুষ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, দূরে কোথাও, মন্দ্রসপ্তক, বাদশাহ নামদার, সাজঘর, বাসর, নৃপতির মতো পাঠক হূদয় জয় করা উপন্যাস আসে তার লেখনীতে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, ১৯৭১, সূর্যের দিনের মতো উপন্যাস। হুমায়ূনসৃষ্ট মিসির আলী ও হিমু হয়ে উঠে পাঠকদের প্রিয় চরিত্র। অনন্ত নক্ষত্র বীথি, ইরিনার মতো কয়েকটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীও লিখেছেন তিনি। যা আজীবন পাঠকদের মনে গেঁথে থাকবে।
হুমায়ূন তার প্রধানত সংলাপনির্ভর উপন্যাসমালায় মধ্যবিত্তের জীবনের নিস্পন্দ রোমান্টিকতাকে নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন বলে সাহিত্য সমালোচকদের মত। তাকে নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’
উপন্যাসের পর নাটক লেখায় হাত দেন হুমায়ূন। এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠায় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের এই শিক্ষক।
’৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান তিনি। এরপর বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাতের মতো জনপ্রিয় নাটকও আসে তার হাত দিয়ে।
নাটক লেখার একপর্যায়ে নির্দেশনায়ও নামেন হুমায়ূন। নাটক নির্দেশনায় হাত পাকিয়ে নামেন চলচ্চিত্র পরিচালনায়। আগুনের পরশমণি দিয়ে শুরু করে শ্রাবণমেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামলছায়ার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমণি কয়েকটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে নানাবাড়িতে হুমায়ূনের জন্ম, যার ডাকনাম কাজল। তার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, মা আয়েশা ফয়েজ।
ব্যক্তি জীবনে কিছুটা টানাপোড়েন ঘটেছিল এই নন্দিত লেখকের। তিনি প্রথম বিয়ে করেন ১৯৭৩ সালে গুলতেকিনকে। তাদের তিন সন্তান হলেন নোভা, শীলা ও বিপাশা। ২০০৫ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বিয়ে করেন শাওনকে। এই দম্পতির দুই সন্তান নিষাদ ও নিনীত।