ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আবারও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রায় ২২ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। আর এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ হবে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গঠিত মূল্যায়ন কমিটি পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য প্রায় ২২ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ৫০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ভিত্তিতে এ সুপারিশ করা হয়। ১৬ জুলাই সকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে বিইআরসি কার্যালয়ে মূল্যবৃদ্ধির গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
শুনানিতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব তুলে ধরেন পিডিবির পরিচালক (সিস্টেম প্লানিং) মিজানুর রহমান। খুব শিগগির খুচরা বিদ্যুতের শুনানি আয়োজনের পর একটি সমন্বিত মূল্যবৃদ্ধির রায় ঘোষণা করা হবে বলে কমিশন জানায়। আর এ নিয়ে চলতি বছর তৃতীয় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। বিইআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে কারও কোন বক্তব্য থাকলে ১৯ জুলাই অতিরিক্ত গণশুনানি করা হবে। তিনি বলেন, মূল্য নির্ধারণ এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। পিডিবি প্রস্তাব করেছে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর। আর আমাদের মূল্যায়ন কমিটি বলছে ২২ শতাংশ বাড়াতে। এ জন্য দাম বৃদ্ধির আগে সরকারপ্রধানের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করবেন বলেও তিনি জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের দুই সদস্য ইমদাদুল হক ও ড. সেলিম মাহমুদ। খবর দৈনিক যুগান্তরের।
বিইআরসি’র মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, পিডিবিকে তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করে পাইকারি মূল্য ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বাড়ানো যেতে পারে। এতে প্রতি ইউনিটে বাড়বে ৮৮ পয়সা। তাতে করে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম হবে চার টাকা ৯০ পয়সা। যদিও পিডিবির প্রস্তাবে দুই টাকা এক পয়সা বৃদ্ধি করে ছয় টাকা তিন পয়সা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি ১ জুলাই থেকে কার্যকরের প্রস্তাব করেছে পিডিবি।
পিডিবির প্রস্তাবে বলা হয়, প্রস্তাবিত পাইকারি মূল্য বাড়ানো না হলে ইউনিটপ্রতি গড় সরবরাহ ব্যয় ও ট্যারিফ ব্যবধান হবে দুই টাকা ৮৫ পয়সা। এতে করে চলতি অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ হবে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এ ঘাটতির পরিমাণও আনুপাতিক হারে বাড়বে। এছাড়া জ্বালানি ব্যয় বাড়লে তাৎক্ষণিকভাবে পাইকারি মূল্য সমন্বয়ের জন্য ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করেছে পিডিবি। তবে কমিশনের মূল্যায়ন কমিটির হিসাবে পিডিবির গড় সরবরাহ ব্যয় হবে চার টাকা ৯০ পয়সা, যা বর্তমান মূল্যের চেয়ে ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর জ্বালানি তেল কমিশন অনুমোদিত বরাদ্দের চেয়ে ২৪৪ কোটি ২৬ লাখ সাত হাজার টাকা কম ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করেছে বিইআরসি।
পিডিবি চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিদ্যুতের সাশ্রয়ী মূল্য নির্ধারণ করতে হলে ৫০ শতাংশ কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। আর এ কয়লা বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ হতে হবে স্থানীয় কয়লা থেকে। এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদনও যোগ হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঠিকমতো চালাতে পারলে এবং তেলের ব্যবহার না বাড়ালে বিদ্যুতের দাম সহনীয় থাকত। চেয়ারম্যান আরও বলেন, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল যথা সময়ে কাজে লাগাতে পারলে বিদ্যুতের দাম আরও সহনীয় পর্যায়ে থাকত।
মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, নিরিক্ষিত ও পরীক্ষিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রেভিনিউ রিকয়ারমেন্ট নির্ধারণ না করে মূল্য ঠিক করার কোন আইনি মানদণ্ড নেই। মূল্যবৃদ্ধির আবেদনটির ওপর অনুষ্ঠিত শুনানি স্থগিত করে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের অনুরোধ করেন তিনি।
এদিকে গণশুনানিতে অংশ নেয়া গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনগণ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ রাখার কথা বলার এক মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য ৫০ শতাংশ বাড়ানোর চেষ্টা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
জানা যায়, ৬ জুন বিইআরসি’র কাছে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে পিডিবি। এ প্রস্তাবনায় পাইকারি পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি (কিলোওয়াট ঘণ্টা) ৪ দশমিক ২ টাকা থেকে ৬ দশমিক শূন্য ২ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে নতুন দাম কার্যকর করার কথা বলা হয় প্রস্তাবে। পাইকারির সঙ্গে সমন্বয় করে খুচরা বিদ্যুতের দাম ৫৩ থেকে ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রস্তাবে বলা হয়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে রাখতে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানোর প্রয়োজন হবে। জ্বালানির বর্তমান মূল্য বহাল থাকলেও প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় হবে ৬ দশমিক ৮৭ টাকা। প্লান্ট ফ্যাক্টরের ব্যাপারে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চে ৬০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টর ধরে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু পিডিবি এর চেয়ে অনেক কম ফ্যাক্টরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তাই আগের বছরের প্রকৃত গড়ের সঙ্গে ১৫ শতাংশ যোগ করে হিসাব করেছে মূল্যায়ন কমিটি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাইকারি পর্যায়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৫ দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বিইআরসি। ২ টাকা ৩৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ২ পয়সা করা হয়েছে। একইভাবে গড়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ বেড়ে ৪ টাকা থেকে ৫ টাকা ২ পয়সা হয়েছে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। সর্বশেষ ২৯ মার্চ পাইকারি ও খুচরা দাম যথাক্রমে প্রতি ইউনিট গড়ে ২৮ পয়সা এবং ৩০ পয়সা বাড়ানো হয়, যা ১ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়।
উল্লেখ্য, পিডিবি একক ক্রেতা হিসেবে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি), ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (ইজিসিবি) ও আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনে। এই বিদ্যুৎ পাইকারি গ্রাহক ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো ও আরইবির কাছে এবং নিজস্ব বিতরণ অঞ্চলে খুচরা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে বলে জানা গেছে।