ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২ হাজার ৭৮টি সেতুর মধ্যে ১৬শ’রও বেশি সেতুর মেয়াদ পেরিয়ে গেছে। যে কারণে এসব সেতুতে ট্রেন চলাচল দিনকে দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল জোনে ব্রিটিশ আমলেই তৈরি হয় অধিকাংশ রেল সেতু। কিছু তৈরি হয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেতুগুলোর বড় অংশের বয়স ৮০ থেকে একশ’ বছর পার হয়ে গেছে। এসব সেতুর অবকাঠামো একেবারেই নড়বড়ে। ট্রেন চলাচল ঝুঁকির মুখে পড়লেই শুরু হয় মেরামত কাজ। আর তা বছরজুড়েই চলে। জোড়াতালি দিয়ে মেরামত শেষ করে আবার সেতু খুলে দেয়া হয় ট্রেন চলাচলের জন্য। এভাবে সেতু সচল রাখার কারণে ট্রেন চলাচলে বাড়ছে ঝুঁকি। মেরামত চলাকালীন সেতু দিয়ে ধীরগতিতে চলার কারণে ট্রেন চলাচল সিডিউল সারা বছরই থাকে এলোমেলো। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে একটি রেল সেতু ভেঙে যাওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ট্রেন চলাচল শুরু হলেও ওই সেতুটির মেরামত কাজ পুরোপুরি শেষ করা যায়নি। এ জন্য এ সেতু দিয়ে ট্রেন পার হচ্ছে ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ-সাত কিমি বেগে। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট পথে চলাচলকারী ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। যে কারণে নির্ধারিত সময়ে ট্রেন পৌঁছাতে পারে না বেশিরভাগ সময়।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রিটিশ আমলে তৈরি এ সেতুটির অবকাঠামো আগে থেকেই ছিল নড়বড়ে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের মতে, এটি প্রবল বর্ষণে পানির স্রোতের তোড়ে ভেঙে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরনো সেতুটির অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরে নড়বড়ে থাকায় প্রবল বর্ষণে টিকতে পারেনি। তাদের মতে, এভাবে ভাঙার মুখে আরও বহু সেতু রয়েছে। এসবের যে কোন একটি ভাঙলে পূর্বাঞ্চলে ফের ট্রেন চলাচলে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে বলে তারা আশংকা প্রকাশ করেছেন। ৮০ ভাগ সেতুর মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক তাফাজ্জল হোসেন জানান, একটি সেতুর মেয়াদ (লাইফ টাইম) সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ বছর। সেই হিসেবে ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেতুগুলোর কোনটির মেয়াদ নেই। মেয়াদ পার হওয়া সেতুগুলোর স্থলে সম্পূর্ণ নতুন সেতু তৈরি করাই নিয়ম। কিন্তু বিপুলসংখ্যক সেতু তৈরি করার মতো আর্থিক সামর্থ্য রেলওয়ের নেই। তাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পুরনো সেতুগুলো নিয়মিত মেরামত করে সচল রাখে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম একটি দৈনিকে এ ব্যাপারে তার মতামত জানান। তিনি বলেন, মেয়াদ চলে যাওয়ার পর কোন সেতুই মেরামত করে সচল রাখা উচিত নয়। এ ধরনের সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বড় একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে এখনই মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া রেল সেতুগুলোর স্থলে নতুন সেতু নির্মাণ করা দরকার।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের সেতু বিভাগ সব সেতুর দেখাশোনা করে। প্রতি সপ্তাহে এলাকা ভাগ করে সেতুগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়। আর মাস শেষে তৈরি করা হয় ভালো ও দুর্বল সেতুর তালিকা। দুর্বল সেতুগুলো মেরামতের জন্য তৈরি হয় প্রকল্প। উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে সেতুগুলোর মেরামত কাজের দায়িত্ব পান নির্বাচিত ঠিকাদার। বিভিন্ন দফতর ঘুরে সেসব সেতু মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ মেলে। ঠিকাদারের মেরামত কাজ রেলওয়ের প্রকৌশলীরা তদারক করেন। দুর্বল কিংবা নড়বড়ে সেতুগুলোর মেরামতে গাফিলতি হলেই ট্রেন চলাচল ঝুঁকির মুখে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, বহু নড়বড়ে সেতুর ব্যাপারে পরিদর্শন রিপোর্ট সময়মত তৈরি করা হয় না। অথবা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় পরিদর্শন রিপোর্ট।
এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) ডিএন সিনহা জানান, ভাটিয়ারিতে ভেঙে পড়া সেতুটির অবস্থা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে ছিলেন রেলওয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা। যার কারণে ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা অবগত হন।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে বহু সেতুর অবস্থা খুবই নাজুক। এসব সেতু দিয়ে ট্রেন চলছে বিরামহীনভাবে। রেলওয়ের নথিতে এসব সেতুকে বিপজ্জনক কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। নিয়মিত পরিদর্শনের সময় কেবল ত্রুটি চিহ্নিত করে সচল রাখা হয় সেতুগুলো। এভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু দিয়ে সারাদেশেই ট্রেন চলাচল অব্যাহত আছে।
দুর্বল সেতু দিয়ে ট্রেন চলছে ধীর গতিতে : বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, জামালপুর, সিলেটের বিভিন্ন স্থানে প্রধান ও শাখা লাইনে আটটি স্পটে নতুন সেতু তৈরি ও পুরনো রেল সেতু মেরামত হচ্ছে। আটটি স্পটেই রেল সেতু দিয়ে ট্রেন চলছে যথাক্রমে ঘণ্টায় পাঁচ, দশ ও পনের কিলোমিটার বেগে। অথচ এসব সেতু দিয়ে ট্রেন চলার কথা ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে। ধীরগতির কারণে এসব সেতু দিয়ে চলাচলকারী ট্রেন নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব হচ্ছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া এলাকায় মেরামত হচ্ছে ৯৬ নম্বর রেল সেতু। এ সেতু দিয়ে ২ মাস ধরে আন্তঃনগর ও লোকাল ট্রেন চলছে ১০ কিলোমিটার বেগে। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে ৩৪ নম্বর রেল সেতু মেরামত চলছে ২০ দিন ধরে। এ সেতু দিয়ে ট্রেন চলছে পাঁচ কিলোমিটার বেগে। ময়মনসিংহ-জামালপুর সেকশনে শম্ভুগঞ্জ এলাকায় একটি নতুন সেতু নির্মিত হচ্ছে। এটির জন্য এখনও কোন নম্বর নির্ধারিত হয়নি। এটির পাশে নড়বড়ে সেতু দিয়ে ৩ মাস ধরে ট্রেন চলছে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার বেগে। নেত্রকোনায় ২৯ নম্বর সেতুর মেরামত কাজ চলছে ২ মাস ধরে। এ সেতু দিয়ে ট্রেন পার হচ্ছে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার বেগে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় ৩২ নম্বর সেতু মেরামত কাজ চলছে তিন মাস ধরে। এ সেতু দিয়ে ট্রেন চলছে ১০ কিলোমিটার বেগে। ময়মনসিংহ-জামালপুর সেকশনে নান্দিনা নামক স্থানে ২৬৬ নম্বর রেল সেতুর মেরামত চলছে ২ মাস ধরে। এটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলছে ১৫ কিলোমিটার বেগে। সিলেটের ভানুঘাট এলাকায় একটি সেতু মেরামত শুরু হচ্ছে। দুর্বল হওয়ায় এটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলছে ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার বেগে। চট্টগ্রাম-দোহাজারী লাইনের গোমদণ্ডি ধলঘাট এলাকায় ২৪ নম্বর রেল সেতু মেরামত হচ্ছে। এ সেতু দিয়ে যাত্রীবাহী ও তেলবাহী ট্রেন চলছে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার বেগে।
যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ট্রেন নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাবে কিভাবে? সরকার ট্রেনের মান বাড়ানোর কথা ভাবছে, ট্রেনের মান বাড়ালে ভাড়াও বাড়ানো হবে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে যাত্রীরাকি অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করবেন? এমন প্রশ্ন এখন সবার মনে। তাই ভগ্ন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুগুলো দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।