ঢাকা রিপোর্ট ডেস্ক ॥ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবার ফারাক্কার পানি বণ্টন নিয়েও নাকি বিরোধীতায় নেমেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে শুধু যে বাংলাদেশ দুঃখ পেয়েছিল তা নয়। স্বয়ং ভারতের অনেক বাঘা বাঘা বাঙালিও মমতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের প্রতি মমতার এই রুঢ় আচরণ দেখে ভারতীয় বাঙালিরাও তাঁর বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। বলেছেন, “মমতার এ আচরণ ঠিক নয়, বাংলাদেশ আমাদের সবচেয়ে বন্ধুসুলভ দেশ তাদেরকে এভাবে অবজ্ঞা করা যায় না।”
এবার আবার সেই পুরনো কাহিনীর বিস্তার ঘটতে যাচ্ছে। তিস্তার পর এবার ফারাক্কার পানি বণ্টন নিয়েও দিল্লির বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুললেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তৈরি হওয়া সংকট মিটিয়ে ফেলতে কলকাতায় ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পাঠানো ‘দূত’ ভারতের বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাইকেও গোটা বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো কড়া কথা শুনিয়েছেন মমতা। প্রকাশ্যে রঞ্জন মাথাই ‘আলোচনা সন্তোষজনক’ বলে জানিয়ে গেলেও বৈঠকের ভেতরের খবর দু’জনেরই কেউই জানাননি। জানা গেছে, মমতা প্রধানমন্ত্রীর দূতকে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আগে ফারাক্কার ভাঙা গেট মেরামত করুন, বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি দেওয়া বন্ধ করুন, তারপর তিস্তা নিয়ে কথা হবে। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কোনভাবেই তিস্তা ইস্যুতে দিল্লির ইচ্ছামতো পানি দেয়া সম্ভব নয়।’ কলকাতায় মমতার কাছে যেসব প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন রঞ্জন মাথাই তার কোনটাই যে ফলপ্রসূ হয়নি, তা বোঝা গেছে থমথমে মুখে রাইটার্স ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া দেখে। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মমতা-মাথাই বৈঠক যে বাংলাদেশের জন্য কোন সুখবর দিতে পারেনি তা যেমন বাস্তব, তেমনি তিস্তা সংকট আরও গভীর হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের খবর।
ফারাক্কার স্লুইস গেট ভেঙে বাংলাদেশে অতিরিক্ত পানি যাওয়া নিয়ে অভিযোগ তুলে থামেননি মমতা, বরং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে রীতিমতো কড়া চিঠি লিখেছেন এবং নিজের এক দাপুটে মন্ত্রী মনীশ গুপ্তকে ফারাক্কাতেও পাঠিয়েছেন। মমতার অভিযোগ, ফারাক্কার দুটি স্লুইস গেট ভেঙে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন ৮ হাজার কিউসেকের জায়গায় বাংলাদেশ ভারত থেকে পানি পাচ্ছি ৪৮ হাজার কিউসেক। মমতার মন্ত্রীর রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে, ফারাক্কার স্লুইস গেট মেরামত না হওয়া পর্যন্ত লাগোয়া পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাবে পশ্চিমবঙ্গ। মমতার সরকারের অভিযোগ, ধারাবাহিকভাবে আরও মাসদুয়েক এমন পানি গেলে শুকিয়ে যেতে পারে কলকাতা বন্দর। স্বভাবতই বাংলাদেশকে পানি দেয়ার ইস্যুতে আবারও পশ্চিমবঙ্গের ‘স্থানীয়’ সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে দিল্লির বিরুদ্ধে আরও একদফা কামান দাগতে শুরু করেছেন মমতা। বিশেষ করে যখন মনমোহন সিং নিজেই তিস্তা চুক্তি দ্রুত সম্পূর্ণ করতে চাইছেন তখন ফের ফারাক্কা ইস্যুকে সামনে রেখে দিল্লি-বিরোধী হাওয়া গরম করতে চাইছেন মমতা। বিদেশসচিবের সঙ্গে বৈঠকের আগে নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ও সেচ সচিব অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মমতার মুখ্যসচিব। পরে কল্যাণ বাবু ফারাক্কার বিষয়ে বলেন, ব্যারাজে ২১.৯ মিটার পানি না থাকলে ‘ফিডার ক্যানেল’ দিয়ে ভাগীরথীতে পানি ঢোকে না। এখন ব্যারাজে পানির স্তর ২১.৯ মিটার থেকে দুই মিটার নেমে গেছে। ফিডার ক্যানেলে পানি আসছে না। এর ফলে ফারাক্কায় এনটিপিসির বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি ভাগীরথীর পানিতে বালির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জঙ্গিপুর এলাকায় ভাঙন বেড়েছে।
জানা যায়, শুধু তিস্তা চুক্তিই নয়, মমতার তীব্র আপত্তিতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে আটকে থাকে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল হস্তান্তরও। মমতার বক্তব্য, এর ফলে রাজ্যের বেশি জমি চলে যাবে। আর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি সেটা হতে দিতে পারেন না। দিল্লির যুক্তি, ছিটমহলের এ জমিগুলো ১৯৪৭ সাল থেকেই কোন দেশ ব্যবহার করতে পারেনি। দু’দেশের ওই এলাকার মানুষও চান, ছিটমহল হস্তান্তর করা হোক। কিন্তু মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে না হলেও রাজ্যের ভাগের পানি বা এলাকা কমে যাওয়া- কোনটাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজি নন। তার যুক্তি, তিনি একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। নেহেরুর কূটনীতি মেনে জমি দিয়ে শান্তি কেনার কথা তিনি ভাবতে যাবেন কেন? ফারাক্কা ব্যারাজ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুটি স্লুইসগেট খারাপ হওয়ায় বাংলাদেশকে অনেক বেশি পানি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রও একই কথা জানান। প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সেখানে গত বছর দুটি স্লুইসগেট অকেজো হওয়ায় বছরে বাংলাদেশ প্রায় ৮২ হাজার কিউসেক পানি পাচ্ছে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ৩৫ হাজার কিউসেক পানি। এতে আশংকা করা হয়, এ হারে পানি বেরিয়ে গেলে পানির স্তর এতটা নেমে যাবে যে এনটিপিসির জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। ফলে রাজ্যজুড়ে বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দেবে।
এমন সব নানা অভিযোগ উঠিয়ে মমতা ব্যানার্জি প্রকারান্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। নিজ রাজ্যের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি বন্ধু দেশটিকে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের মধ্যেই নিপতিত করছেন- যা বাংলাদেশ তথা বাঙালিরা কখনও আশা করেনি।