ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ নন্দিত লেখক হূমায়ুন আহমেদের বড় ছেলে নুহাশ বাবার কাছ থেকে অনেক দিনই দূরে থেকেছেন। কারণ তার মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর খুব কমই যোগাযোগ হয়েছে। তবে নুহাশ তার বাবাকে খুব অনুভব করতো। নিচের চিঠিটি অন্তত সে সত্যের ইঙ্গিত বহন করে।
[বাবার প্রথম অপারেশনের কিছুদিন পর জুলাইয়ে আমি তাকে একটি চিঠি লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম, নিউইয়র্কে বাবার কাছে থাকা আমার চাচা ও চাচীকে এটা ইমেইল করবো। আমি চাইছিলাম, বাবার যখন জ্ঞান ফিরবে, তারা তাকে চিঠিখানি পড়ে শোনাবেন। তিনি পড়তে পারছিলেন না, মৃত্যুর আগেও তার পুরোপুরি জ্ঞানও ফেরেনি। আমার বুকটা সারাক্ষণ একটা অব্যক্ত ব্যথায় গুমরে মরে। কারণ আমি আমার কথাগুলো তাকে জানাতে পারিনি। এটি একান্তই ব্যক্তিগত চিঠি, কিন্তু আমি আমার কেবলই মনে হয়, এই কথাগুলো তাকে যদি জানাতে পারতাম, যদি পারতাম, আমার মনের এই হাহাকার হয়তো কিছুটা হলেও দূর হতে পারতো।]
বাবা,
আশাকরি ভালো আছো। আমার শরীরটা তেমন ভালো নেই। টাইফয়েড হয়েছিল। তারপর থেকে আমার পেটে কিছুই সহ্য হচ্ছে না। সারা সপ্তাহ জুড়ে কেবল নরম ভাতের জাউই খেয়ে চলেছি। এই বিশ্রী জাউ খাচ্ছি আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল ভাবছি কখন সুস্থ হয়ে ভালো ভালো খাবার খেতে পারব। এক সময় গলদা চিংড়ির জন্য আমার ভারি লোভ হচ্ছিল, সেই সঙ্গে মনে পড়ছিল একটা ঘটনার কথা।
মায়ের সঙ্গে তোমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর আমার সব কিছুই ওলটপালট হয়ে গেল। সারাক্ষণ ভাবতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি আমাদের কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু পরে বুঝলাম, দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের মত। রসায়নের ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, আমি দেখলাম একটি দহন ; একটি প্রজ্বলন, যা থেকে আর ফেরার কোন পথ নেই।
আমার সবচেয়ে ভয় ছিল, তোমার সঙ্গে আমার দূরত্বটা বেড়ে যাবে। তুমি আর আমাকে আগের মত তোমার ছেলে হিসাবে দেখবে না। ডিভোর্সের কিছুদিন পর তুমি আমাকে ডেকে পাঠালে। বললে, তুমি এইমাত্র বাজার থেকে কিছু বড় গলদা এনেছো। সেগুলো তুমি রান্না করে আমার সঙ্গে তোমার বাসায় বসে খেতে চাও। আমরা দু’জনেই জানতাম যে, তা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে সম্পর্কের যে টানাপড়েন চলছিল, তার মধ্যে আমরা ভোজসভা বসাতে পারি না। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হলো না। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ইন্টারকমটা বাজতে লাগল। দারোয়ান আমাকে জানালেন যে, বাবা গেটের বাইরে একটা জ্যান্ত গলদা চিংড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। খানিকটা খুশি, খানিকটা উত্তেজনা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। তুমি বললে ‘বাবা, আমি সত্যিই এগুলো তোমার সঙ্গে বসে খেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়। তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যাই ঘটুক, আমি সব সময় তোমার সঙ্গে আছি। একদিন আবার আমরা দু’জনে এক সঙ্গে বসে ভালো খাবার খাবো। কিন্তু এখন আমি চাই, এগুলো তুমি রেখে দাও।’ তুমি তখন আমাকে একটি জ্যান্ত গলদা চিংড়ি দিয়ে গেলে। ছোটো উজ্জ্বল চোখ ও লম্বা সরু পাওয়ালা সেই বিপজ্জনক প্রাণীটা আমার কাছে আশার বার্তা বয়ে আনল। যাই ঘটুক, তুমি সব সময় আমার পাশে থাকার চেষ্টা করবে- সেই আশায় বুক বাঁধলাম।
আমি কিন্তু পারিনি তোমার কাছে থাকতে, যতটা আমার থাকার দরকার ছিল। যখন তোমাকে আমি ফোন করেছি, বলতে গেলে তখন তুমি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলে না। যখনই তোমার সঙ্গে কথা বলতাম, আমি এমনই ভেঙে পড়তাম যে কিছুই গুছিয়ে বলতে পারতাম না। আমি তো তোমার মতো কথার কারিগর ছিলাম না! অপারেশনের আগে যখন ঢাকায় এলে, তোমার সঙ্গে দেখা করাটা ছিল আমার জন্য বেদনাদায়ক। তোমার বাড়ির দরজায় গেলে আমাকে থামিয়ে দেয়া হতো, এটা যে কত কষ্টের! কোনো সন্তানই চায় না তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে প্রতিবার বাড়ির দারোয়ানের জেরার সম্মুখীন হতে। তবে এটা কোন অযুহাত নয়। আমার উচিত ছিল তোমার কাছে আমার আরো বেশি থাকা। কেবলই মনে হয়, সব কিছু যদি পাল্টে দিতে পারতাম! তোমাকে যদি বোঝাতে পারতাম, তোমাকে ছেড়ে কতটা কষ্ট হচ্ছে আমার, যদি তোমাকে বলতে পারতাম, তোমার কাছে থাকতে পারিনি বলে কতটা দগ্ধ হচ্ছি প্রতিমুহূর্তে! এই চিঠিটাই তোমাকে দেয়া আমার গলদা চিংড়ি।
তোমার ছেলে, নুহাশ
[ডেইলি স্টারের উদ্ধৃতি দিয়ে চিঠিটি ছেপেছে দৈনিক ইত্তেফাক]