ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ বাংলা ভাষার আজ সেই দিন, যেদিন এদেশের ছাত্র-জনতা মাতৃভাষার জন্য আত্ম উৎসর্গ করেছিলেন। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ভাষার গৌরব হাজার বছরের। এই হাজার বছরের গৌরবকে ধরে রাখতে এদেশের মানুষ সংগ্রাম-রক্ষদান থেকে শুরু করে সব কিছুই করেছে। আজ আমরা এই ভাষার জন্য গর্বিব।
এই বাংলা ভাষাকে নিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাঙালির সভ্যতা ও ভাষার মধ্যে গ্রহণশীলতা ও প্রশ্নপ্রবণতা দুটিই সমানভাবে রয়েছে। ইদানীং দারিদ্র্য আর অভাবের প্রভাব আমাদের চিন্তাধারায় খুবই বেশি। এই অভাবগ্রস্ত অবস্থা বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সত্য নয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি ছিল। বাংলা পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে অনেক সাবলীল ও সমৃদ্ধ ভাষা। নতুন কিছু গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বীকার থাকতে হবে।
২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এক সেমিনারে ‘বাংলা সভ্যতার কয়েকটি দিক’ প্রবন্ধে ও প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা বলেন। আন্তর্জাতিক বাঙালি’র উদ্যোগে প্রথম বিশ্ব বাঙালি সম্মেলনের অংশ হিসেবে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সেমিনার সঞ্চালনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক মফিদুল হক। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেন, রাজনৈতিক কারণে ও ইতিহাসের ঘটনাক্রমে প্রাচীন বাংলাদেশ এখন বিভক্ত। কিন্তু বাঙালির একাত্মতার ভিত্তি প্রধানত রাজনৈতিক নয়। সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত এবং চিন্তানির্ভর সভ্যতার ঐক্যের জোর রাজনীতি থেকে কম নয়। তারই সঙ্গে আছে সমাজ চেতনার চিন্তামুখী আলাপ আলোচনা। এর প্রভাব রাজনীতির ওপর পড়বে। কিন্তু নৈকট্যের ভিত্তি একমাত্র রাজনীতিতে নয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথের একটি লেখার উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন বলেন, সে সময় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল। এ দেশের সঙ্গে উৎপাদন এবং বাণিজ্যভিত্তিক যোগাযোগ রাখতে খুবই উদগ্রীব ছিল তখনকার পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, ইংরেজ, ডেনিস ও বহু ইউরোপীয় দেশ। আমাদের সাহিত্যের এবং কৃষ্টির অনেক উৎস অবশ্য ধনমুখী নয়। যেমন বাউল সংস্কৃতি, অন্যান্য হাজার রকমের সুন্দর পল্লী সঙ্গীত আর পল্লীকাব্য। তারই পাশাপাশি চলেছিল শহরমুখী বর্ধিষ্ণু সংস্কৃতির প্রসার, প্রবন্ধ, সমালোচনা, কবিতা, কাহিনী, গান-বাজনার সুব্যবহার। বাঙালির চিন্তাধারায় সাবলীলতার মধ্যে যেমন আছে আমাদের পল্লীজীবনের সামর্থ্য, তেমনি আছে আমাদের শহুরে জীবনের সমৃদ্ধির পরিচয়।
অমর্ত্য সেন আরও বলেন, বাংলা ভাষার নানা উৎস নানাদিক থেকে এসেছে। এর গ্রহণশীলতা এবং সমন্বয় প্রীতির মর্যাদা দেয়া প্রয়োজন। রয়েছে প্রশ্ন প্রবণতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন অক্সফোর্ডে হিবার্ট লেকচার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, তার পারিবারিক সংস্কৃতি হিন্দু, মুসলিম ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল। এই মর্যাদাটি তিনি জোর গলায় ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিলেন। কবি নজরুল ইসলাম অন্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিজের বিদ্রোহী প্রবৃত্তির পার্থক্য করেছিলেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে সম্মান জানিয়েই তিনি ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে নজরুলের নিজস্ব চিন্তার পরিচয় আছে। একই সঙ্গে আছে প্রশ্নপ্রবণ রবীন্দ্রশ্রদ্ধা।
এক প্রশ্নের জবাবে সেন বলেন, কোন বাঙালি যদি বাংলা ভাষায় কথা বলতে না পারে, সেটা তার ক্ষতি। আমি বাংলা ভাষায় কথা বলি, কারণ আমি বাংলায় কথা বলে আনন্দ পাই। বাংলা আমার জীবনের অংশ। বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনীহার কারণ খুঁজে দেখতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, অন্যদের সংস্কৃতি গ্রহণ, নতুন সংস্কৃতির চয়ন এবং গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজ ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের ঐতিহ্যকে হেয় করলে তার প্রতিবাদ জানাতে ভুল করা যাবে না। বিশ্ব ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মর্যাদার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বাঙালি ও বাংলা ভাষার যে দিকগুলো বড় রকমের স্বীকার পেয়েছে, তা থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে থাকলে চলবে না। সেই ঐশ্বর্যগুলো ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এটি পশ্চাৎমুখী চিন্তার পরিচায়ক নয়। নতুন, চিন্তার মধ্যেও, বিদ্রোহী চিন্তার মধ্যেও অতীত-ঐতিহ্যের স্বীকারের প্রয়োজন খুবই প্রশস্ত। বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক সব সমৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রসারের চেষ্টা চলবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানটি যেনো বাংলা তথা বাঙালিদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল, যা সচরাচর চোখে পড়ে না।
(তথ্য সূত্র: দৈনিক যুগান্তর)