ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও আমাদের দেশে এই শিশুশ্রমের মূলে রয়েছে দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণেই মূলত শিশুরা শ্রমিক হিসাবে কাজে জড়িয়ে পড়ছে। নিরানন্দ শিক্ষার অভাবেও এমন ঘটনা ঘটছে। তাই আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা দেয়া ও খাদ্য নিরাপত্তা দেয়া গেলে এ সঙ্কট অনেকটাই কমে আসত বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রম কখনোই বন্ধ করা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দরিদ্র শিশু শ্রমিকদের কাজ থেকে সরিয়ে নিলে তাদের পরিবার ও নিজেদের না খেয়ে থাকতে হবে। কারণ এসব ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা মূলত নিজের খাবার জোগাড়ের তাগিদেই কাজ করতে বাধ্য হয়। শিশুশ্রম বন্ধের চিন্তা না করে শিশুদের উপযোগী স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে হাল্কা কাজ এবং কাজের পাশাপাশি তাদের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থাসহ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে এই শিশুদের জন্য কিছু করা হবে। সেইসঙ্গে এসব শিশু শ্রমিককে লেখাপড়ার সিলেবাসে কম্পিউটার, ভোকেশনাল ট্রেনিং, ইংরেজি অন্তর্ভুক্ত করে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে স্বল্প সময়ে তাদের দক্ষ করে তোলা গেলে এসব শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে না গিয়ে ভালো কিছু কাজ করতে পারে।
আনুমানিক সাত বছর বয়স দেলোয়ারের। কাগজ কুড়ানোর কাজ করে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে। ছোট্ট দেলোয়ারের সঙ্গে কথা হয় রাত সাড়ে ১১টার দিকে। তখনো সে প্লাস্টিকের বোতল আর কাগজ কুড়াচ্ছিল। জামাবিহীন শরীরে মাথায় ময়লা সাদা রংয়ের টুপি। পরনের হাফ প্যান্টটি পেটের নিচে পড়ায় পায়ের হাঁটু অবধি ঢেকে আছে। দেলোয়ার বোতল কুড়ায় আর দূরপালস্নার বিভিন্ন ধরনের যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘এতো রাতে বাসায় ফিরতে ভয় করবে না জানতে চাইলে দেলোয়ার বলে, মাও বোতল কুড়াইতে গেছে, আমারে আইসা নিয়া যাইবে। কোথায় থাকো জানতে চাইলে দেলোয়ার বলে, ওই সামনের বস্তিতে। তোমার বাবা দেলোয়ার বলে, ‘আব্বায় আরেকটা বিয়া কইরা চইল্যা গেছে। আমরা দুই ভাই এক বইন মায়ের লগে থাকি। পড়ালেখা কর কিনা জানতে চাইলে, সাফ জানিয়ে দেয়, ‘পড়ি না’, তোমার পড়তে ইচ্ছে করে না দেলোয়ারের উত্তর, ‘স্কুলে পড়া না পারলে স্যারে মারে, হের লাইগ্যা স্কুল যাইতে মন চায় না।’
দেলোয়ারের মতো লাখ লাখ শিশু শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬৭ লাখ ৮৪ হাজার। এর মধ্যে ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ছেলে শিশু ৪ লাখ ৩৪ হাজার এবং মেয়ে শিশু ৩ লাখ ৩৩ হাজার। শিশুদের শতকরা ৯৪ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং বাকি ৬ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। মোট শিশু শ্রমিকের শতকরা ৬৬ ভাগ কৃষিতে, ৮ ভাগ শিক্ষা খাতে, ২ ভাগ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, ১৪ ভাগ গৃহভৃত্য ও অন্য কাজে এবং ১০ ভাগ অন্যান্য সেবা খাতে নিয়োজিত। শিশু শ্রমিকের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগ গ্রামে এবং বাকি ১৭ ভাগ শহর এলাকায় বাস করে। শহর অঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে দেশে শিশু শ্রমিকের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তথ্য: দৈনিক ইত্তেফাকের।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিশুদের মতো বাংলাদেশেও শিশুরা জীবিকার তাগিদে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে সারা বিশ্বেই বেঁচে থাকার তাগিদে কয়েক’শ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে কাজ করছে এমনই ২১৫ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক। এই শিশুদের অর্ধেকই আবার ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে এসে এসব শিশু তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি অবসর, বিনোদন, সাধারণ স্বাধীনতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। শিশু শ্রমিকদের একটি বড় অংশ আবার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষ করে বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করছে এসব শিশু।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল সিপার সম্প্রতি শিশুশ্রম বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রম রয়েছে। এটা এখন আন্তর্জাতিক সমস্যা। তবে বাংলাদেশে শিশুশ্রম রোধে সরকারের ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা’ উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। এর তৃতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণ এখন চলছে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ইতিমধ্যে ১৪ হাজার শিশু শ্রমিককে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ৫০ হাজার শিশুকে দক্ষ করে তোলা হবে। উদ্দীপনের নির্বাহী পরিচালক এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কখনই শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের প্রতি এক্ষেত্রে আলাদা নজর দিতে হবে। রূপান্তরের নির্বাহী পরিচালক স্বপন গুহ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও শিশুশ্রমের ঘটনা বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে ঝরে পড়ার সংখ্যা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে যেসব এলাকায় বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানে ঝরে পড়ার সংখ্যা বেড়ে যায়।
তাই শিশুশ্রম হয়তো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব নয়, কিন্তু কিছু পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।