দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বছরের পর বছর ধরে বিচারধীন থাকায় দেশের সরকারি জমি বেহাত হচ্ছে। বছরের পর বছর আপিল না করায় এসব জমি হাতছাড়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ভূমি মন্ত্রণালয় সরকারি হাটের জমি ব্যক্তি মালিকানায় নামজারি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিসির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার একটি হাটের প্রায় ৪০ শতক জমি ব্যক্তির নামে ছেড়ে দেয়ার জন্য বুধবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অথচ রেকর্ডে জমিটি সরকারি হাট হিসেবে চিহ্নিত। একটি বণ্টননামা মামলায় সরকারকে বিবাদী করে আদালতের রায়ের মাধ্যমে ডিক্রি নেয়া হয়েছে। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে সরকার চল্লিশ বছরেও কোন আপিল করেনি। এখন হাইকোর্টে আপিল করার প্রস্তাব দেয়া হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। অপর একটি ঘটনায় আদালতে ভুল তথ্য উপস্থাপনের কারণে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সরকারের ১ একর ২০ শতক জমি বেহাত হয়ে গেছে। রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল রিভিশন করার সুযোগ থাকলেও ২৩ বছর ধরে তা করা হয়নি। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ তিন দফায় হাইকোর্টে আপিল করার নির্দেশনা দিলেও তা কার্যকর হয়নি।
হাটের জমি ব্যক্তি মালিকানায়!
চাঁদপুরের কচুয়ার তুলপাই ফতেপুর মৌজায় তুলপাই বাজারে সরকারি জমির পরিমাণ ১ একর ৬৬ শতক। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে একটি বণ্টননামা মামলায় ৩৯.৫০ শতক জমি ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি হিসেবে দাবি করা হয়। এ নিয়ে আদালতে মামলা দায়ের হয় ১৯৬১ সালের ২৭ মার্চ। এ মামলায় বাদী পক্ষে রায় ও ডিক্রি হয় ১৯৬৯ সালের ১৪ অক্টোবর। কিন্তু এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোন আপিল করা হয়নি। নিয়মানুযায়ী রায়ের সার্টিফাইট কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হয়। তবে সময়সীমা উত্তীর্ণ হলেও বাস্তব কারণ বিবেচনা করে আদালত আপিল বিলম্বের আবেদন মঞ্জুর করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তিন যুগ পার হওয়ার পরও আপিল করা হয়নি।
এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ডিসি অফিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৪ হাজার ২৬১ দিন বা প্রায় ৪০ বছর বিরতি দিয়ে ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করা হয়। এত দীর্ঘ সময় তামাদি হয়ে যাওয়ায় আদালত আপিল খারিজ করে দেন। এরপর এ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে চাইলে জিপি’র মতামতে বলা হয়, অনেক বিলম্ব হওয়ায় ফল পাওয়া যাবে না। এসিল্যান্ড ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও একই মত দেন। এরপর ডিসি প্রিয়তোষ সাহা এ জমি নিম্ন আদালতের রায়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নামজারি করে দেয়ার জন্য ৮ আগস্ট ভূমি সচিবের কাছে প্রস্তাব পাঠান। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয়ের শাখা থেকে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়, প্রথমত, উচ্চ আদালতে আপিল করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, আপিল করতে সম্মত না হলে ডিসির প্রস্তাব অনুমোদন করা যেতে পারে। সচিব আপিল করার পক্ষে জোরালো মত দেন। তবে ভূমি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ও ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা আপিলের পরিবর্তে নামজারি করে দেয়ার জন্য ডিসির প্রস্তাব অনুমোদন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সময়মতো আপিল না করায় সরকারের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে। কোন মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে রায় হলে রায়ের সার্টিফাইট কপিও যথাসময়ে উত্তোলন করা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীল লোকজন বাদী পক্ষের সঙ্গে আপসরফা করে আদালতে শক্তভাবে ভূমিকা রাখা থেকে বিরত থাকে। সরকারের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করা হয় না। বাদী পক্ষও রায় নিয়ে বছরের পর বছর চুপচাপ বসে থাকে। আপিল করার সময়সীমা বহুদিন তামাদি হয়ে যাওয়ার পর রায় বাস্তবায়নের জন্য আবেদন করে।
সংশ্লিষ্ট জমির বিষয়ে কর্মকর্তারা বলেন, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০-এর ২০ ধারা অনুযায়ী জমিদারগণ ৩৭৫ বিঘার বেশি জমি দখলে রাখতে পারবেন না। এছাড়া জমিদারের দখলে কোন বনভূমি, হাট-বাজার, ফেরিঘাট ও জলমহাল থাকতে পারবে না। ফলে কচুয়ার তুলপাই হাটের জমি জমিদারের দাবি করলেও এ আইন অনুযায়ী তা ব্যক্তির নামে আর থাকবে না। হাটের জন্য নতুন করে এ জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজনও হবে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, চল্লিশ বছর ধরে কেও আপিল করেনি।
কচুয়ার ইউএনও ও এসিল্যান্ডের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সহকারী সচিব জিয়া আহমেদ সুমনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি এখানে নতুন এসেছেন। বিষয়টি তার জানা নেই।
কানুনগো আবদুল্লাহ আল মাহমুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে দুই উপজেলার দায়িত্বে আছেন। কচুয়াতে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন অফিস করেন। তাই এ বিষয়ে ভালোভাবে কিছু বলতে পারবেন না। নাজির মফিজ উদ্দিন বলেন, তহশিলদার আলী আশরাফ এ বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছেন। তিনি ভালো বলতে পারবেন। আলী আশরাফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চল্লিশ বছর পর ২০০৮ সালে আপিল করলেও জিপি শক্তভাবে ভূমিকা রাখেননি। মামলার স্বপক্ষে তেমন কোন কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। এ কারণে আপিল খারিজ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তার রিপোর্টে এসব দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। চাঁদপুরের ডিসি প্রিয়তোষ সাহা বলেন, তিনি শত চেষ্টা করলেও এখন এ জমি ধরে রাখতে পারবেন না। কেননা, চল্লিশ বছর আগে যে আপিল করা প্রয়োজন ছিল তা কেও করেনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব দায়িত্বে সেসময় যারা ছিলেন তারা কেও আর বেঁচে নেই।
ভূমি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডিসির পাঠানো রিপোর্টের একটি লাইন পড়ে খুবই হতবাক হয়েছি। যেখানে বলা আছে, ‘১৪ হাজার ২৬১ দিন আপিল করা হয়নি।’ তিনি বলেন, এর চেয়ে আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! কিছু অসৎ সরকারি কর্মকর্তার কারণে এভাবে সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তবে এ জমিটি সরকারি সম্পত্তি বলে দাবি করলেও এখন আর কোন ফল পাওয়া যাবে না বলে তিনি মনে করেন। তাই অহেতুক উচ্চ আদালতে আপিল করার সিদ্ধান্ত দিয়ে কাওকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলতে চাননি।
এভাবে সারাদেশের বহু সরকারি জমি ব্যক্তি মালিকানায় চলে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে হাজার হাজার বিঘা সরকারি জমি বেহাত হচ্ছে। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগ ভেবে দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।