স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ বিপিএলের প্রথম আসরে শিরোপা নিলো ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স। ২৯ ফেব্রুয়ারি একপেশে ফাইনালে তারা বরিশাল বার্নার্সকে আট উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে বরিশাল প্রথমে ব্যাট করে সাত উইকেটে মাত্র ১৪০ রান করে। জবাবে ১৫.৪ ওভারে দুই উইকেটে ১৪৪ রান করে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ঢাকা। জয়সূচক রান আসে নাজমুল ইসলাম অপুর বলে আনামুল হক বিজয়ের ব্যাট থেকে।
যেমন আশা করা হয়েছিল সে রকম জমজমাট হয়নি ফাইনাল। স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ আশা করেছিল দর্শকরা। কিন্তু তা হয়নি। এর কারণ প্রথমে ব্যাট করে বরিশাল বড় স্কোর গড়তে পারেনি। টি ২০ ক্রিকেট রানের খেলা। বিপিএলে অধিকাংশ ম্যাচই হয়েছে বিগ স্কোরিং। এমনকি দুটি সেমিফাইনালও ছিল বিগ স্কোরিং এবং উত্তেজনায় ঠাসা। কিন্তু ফাইনাল হল ম্যাড়মেড়ে ও একপেশে। বিপিএলে এত কম রান করে জয়ের রেকর্ড খুব একটা নেই। ১৪০ রান করে আর যা-ই হোক জয়ের আশা করা যায় না। আসলে দিনটি ছিল ঢাকার। ব্যাটে-বলে তারা এমন দেখান যে বরিশালের ক্রিকেটাররা প্রতিদ্বন্দ্বিতার দেয়াল গড়তে পারেননি। উইকেটের চরিত্রও ছিল ভিন্ন। সেমিফাইনালের দুটি ম্যাচেই রান হয়েছে। ফাইনালে বরিশালের ব্যাটসম্যানরা রান করতে সংগ্রাম করেছেন। অথচ ঢাকার ব্যাটসম্যানরা রান করেছেন হেসেখেলে। উইকেটের এমন দ্বিমুখী আচরণের কারণেই ফাইনাল একপেশে হয়ে ওঠে। ঢাকা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক ছিল ঢাকার সমর্থক। তাদের গগনবিদারী আওয়াজে বারবার ঢাকা ঢাকা শব্দে স্টেডিয়াম প্রকম্পিত হয়েছে। কিন্তু তার পরও অতৃপ্তি নিয়ে তারা ফিরেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়। আফ্রিদি ঝড় তারা দেখতে পারেনি। এমনকি আহমেদ শেহজাদ ঝড়ও ছিল না। ব্র্যাড হজ ঝড় ছিল। তবে তা তার আগের ম্যাচগুলোর মতো ছিল না। তুলনা করলে তা পানসে মনে হবে। আর আফ্রিদি ঝড় না থাকলেও ইমরান নাজির ঝড় ঢাকার জয়কে সহজ করে দেয়। মাত্র ৪৩ বলে ছয়টি করে চার ও ছয় মেরে ৭৫ রান করেন নাজির। আফ্রিদি ঝড়ের পরিবর্তে ইমরান নাজির ঝড় দেখে দর্শকরা বাহবা দিতে পারে তাকে। নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে উদ্বোধনী জুটিতে মাত্র ২৬ রান আসার পর শুরু হয় ইমরান নাজির তাণ্ডব। শুরুতে উইকেট পড়ায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে ধারণা করেছিল অনেকে। কিন্তু নাজিমুদ্দিনের আউট বরিশালের জন্য আরও ‘কাল’ হয়ে ওঠে। আনামুল হক বিজয়ের সঙ্গে নাজিরের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১১০ রান আসে মাত্র ১১.৪ ওভারে। আলাউদ্দিন বাবুর বলে আহমেদ শেহজাদের হাতে ধরা পড়ে বিদায় নেন ইমরান নাজির। তিনি আউট হওয়ার পর আজহার মাহমুদ মাত্র এক বল খেলার সুযোগ পান। অপর প্রান্তে আনামুল হক বিজয় চার মেরে দলকে উল্লাসে মাতার উপলক্ষ এনে দেন। ম্যাচটি এ রকম একপেশে হওয়ার আরও একটি কারণ ছিল বরিশালের ফিল্ডারদের ক্যাচ মিসের মহড়া।
বরিশাল মানেই দুরন্ত ব্যাটিং। চার-ছয়ের বাহারি সমাহার। বিপিএলের প্রথম ম্যাচেই ক্রিস গেইলের কল্যাণে টি ২০ ক্রিকেটের সব রোমাঞ্চ নিয়ে হাজির হয়েছিল বরিশাল বার্নার্স। পরে গেইল চলে গেলেও আহমেদ শেহজাদ ও ব্রাড হজ সমান তালে চার-ছয়ের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন। এ দু’জনের কারণে সেমিফাইনালে রাজশাহীর ১৮৪ রানের পাহাড় বরিশাল অতিক্রম করেছিল মাত্র ১৬ ওভারে। ফাইনালেও সবাই অপেক্ষায় ছিলেন একই রকম ঝড় দেখার। ফাইনাল হবে জমজমাট। বড় স্কোর হবে। প্রতিপক্ষও পাল্টা জবাব দেবে। প্রতিপক্ষ যে ঢাকা। আফ্রিদি যোগ দেয়ার পর ঢাকার আত্মবিশ্বাসের পালে লেগেছে নতুন হাওয়া। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। বরিশালের ব্যাটসম্যানরা এবার আর আগুনে পোড়াতে পারেননি ঢাকার বোলারদের। পুরো ২০ ওভার খেলে সাত উইকেটে করেছে মাত্র ১৪০ রান। ওভারপ্রতি রান মাত্র সাত করে। যা টুয়েন্টি ২০ ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। বরিশালের ইনিংস শেষ হওয়ার পর এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে যায় ঢাকার শিরোপা জয়। বাকি যা ছিল তা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।
বিগ স্কোরিং দুটি সেমিফাইনালের পর লো স্কোরিং ফাইনাল দেখল বিপিএল। টস জিতে বরিশালকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানানোর পর ঢাকার বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং বরিশালের ব্যাটসম্যানদের এবার আর উড়তে দেয়নি। যদিও শুরুটা ছিল ঠিকই উড়ন্ত। কিন্তু উদ্বোধনী জুটি ভেঙে যাওয়ার পর বরিশালের দুরন্ত গতিতে চলা থেমে যায়। ব্রাড হজ শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৫১ বলে চারটি করে চার ও ছয় মেরে ৭০ রানে। কিন্তু আরও বেশি মারমুখী হতে পারেননি অপর প্রান্তে নিয়মিত উইকেট পড়তে থাকায়। বরিশালের রানের চাকা ধীরগতিতে নেমে আসে মূলত ঢাকার স্পিনাররা আক্রমণে আসার পর। দুই উদ্বোধনী বোলার অধিনায়ক মাশরাফি ও আজহার মাহমুদ বেধড়ক মার খেলে স্পিনাররা আক্রমণে আসেন। তিন স্পিনার শহীদ আফ্রিদি, সাঈদ আজমল ও ইলিয়াস সানির বলে মোটেই সুবিধা করতে পারেনি বরিশালের ব্যাটসম্যানরা। আফ্রিদি বল হাতে নিয়েই সফল হন। ফিরিয়ে দেন ডেঞ্জার্স ম্যান আহমেদ শেহজাদকে। শেহজাদের রান মাত্র ২৮। সাঈদ আজমলও তার প্রথম ওভারে উইকেট তুলে নেন। তিনি ফিরিয়ে দেন মুস্টার্ডকে ( ৫)। আফ্রিদি তার দ্বিতীয় ওভারে আবারও উইকেট নেন। এবার তার শিকার হন মিঠুন। পরপর তিন ওভারে তিন উইকেট হারিয়ে বরিশাল চাপে পড়ে যায়। সেই চাপ থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা। শতরানের আগেই হারায় ছয় উইকেট। ওভার চলে যায় ১৪.৪। তার পরও যা রান আসে তা ব্রড হজের ব্যাট থেকেই। আহমেদ শেহজাদের ২৮ রান ছাড়া মমিনুল ও ফরহাদ হোসেন শুধু দুই অংকের (১১) রান করে করেন। তিন স্পিনারদের দাপটে ছয় নম্বর বোলার হিসেবে রানা নাভেদ বল হাতে তুলে নেয়ার পর মাশরাফি বা আজহার মাহমুুদের মতো ব্যর্থ হননি। তিনিও স্পিনারদের মতো সফল হন। চার ওভারে ২৪ রান দিয়ে নেন দুই উইকেট। সবচেয়ে সফল ছিলেন আফ্রিদি। চার ওভারে ২৩ রানে তিনি নেন তিন উইকেট। সাঈদ আজমলও চার ওভারে ২৩ রানে উইকেট নেন একটি। ইলিয়াস সানি চার ওভারে ২৭ রান দিয়ে কোন উইকেট পাননি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ বিপিএল এবারই প্রথমবারের মতো আসর বসে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিপিএল-এর ভ্যেনু ছিল। প্রথমবারের মতো হলেও বেশ জমে উঠেছিল এই আসর। ঢাকায় এর জমজমাট উদ্বোধনী হয় ৯ ফেব্রুয়ারি। ভারত-বাংলাদেশের নামী-দামী শিল্পীদের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘটে। প্রথম ম্যাচ হয় ১০ ফেব্রুয়ারি। মোট ৩৩টি ম্যাচ-এর এই খেলা শের-ই বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম ও চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়।