ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ যে ভাষণের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে বঙ্গবন্ধু আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে বুকে ধারণ করে যে জাতি বারবার বিদেশীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, হারিয়েছে পথের ঠিকানা, আজকের এদিনে স্বাধিকারবঞ্চিত বাঙালি জাতি খুঁজে পায় স্বাধীনতার সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের তুলনায় আজকের দিনের বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী, কৌশলী, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। একাত্তরের এদিনে বাঙালি জাতির মহাক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে দেখিয়েছিলেন মুক্তির পথ, স্বাধীনতার দিশা এবং দিয়েছিলেন গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা।
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মুহুর্মুহু করতালি আর গগনবিদারী স্লোগানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই বজ নিনাদ ঘোষণার পর মুক্তিপাগল বাঙালিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার এই ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র জাতিকে অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। এ নির্দেশনা পেয়েই মূলত সারাদেশে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক ভাষণই নয়, এটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রামাণ্য দলিল ও ঘোষণাপত্রও বটে। এ ভাষণ যেমনি সারগর্ভ, তেজস্বী ও যুক্তিপূর্ণ, তেমনি তির্যক, তীক্ষ্ণ ও বলিষ্ঠ। এক অপূর্ব ও নাতিদীর্ঘ উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধু স্বল্প কথায় পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস এবং বাঙালির সুস্পষ্ট অবস্থানের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে দ্বন্দ্বের স্বরূপ, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। তাৎপর্যপূর্ণ ওই ঘোষণার পরই পাকিস্তান সরকারের প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে পড়ে। পূর্ববাংলা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গোটা জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আজকের দিনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উত্তাল জনসমুদ্রে তার জলদগম্ভীর এ নির্দেশনা মুক্তিপাগল লাখ লাখ বাঙালির হূদয়ে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। সেদিন বাঙালি জাতিকে তিনি শুধু মুক্তির এ মহাকাব্যই শোনাননি, দিয়েছিলেন প্রতিরোধ-মন্ত্রণার কলাকৌশলভরা নির্দেশাবলীও। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারিঃ, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলঃ, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করঃ। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে নাঃ, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহঃ।’ এ ঘোষণার পর লাখো জনতার মধ্য থেকে গগনবিদারী স্লোগান ওঠে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর; তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ; আপস না সংগ্রাম- সংগ্রাম সংগ্রাম; জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধুঃ।’
মূলত ১৯৪৭ সাল থেকেই বাঙালির মনের মণিকোঠায় যে ছাইচাপা আগুন, বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ও স্বাধীনতার স্বপ্ন লুকায়িত ছিল- তারই বিস্ফোরণ ঘটে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন ও প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ৩০৫ আসন লাভ করেন। সত্তরের নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয়লাভ এবং সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা হওয়ার মধ্য দিয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রথম ধাপ অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। ভুট্টো আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন এবং তিনদিনের আলোচনা ব্যর্থ হয়। ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু এর তীব্র বিরোধিতা করেন। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করলে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম ও বিশাল ত্যাগী জীবনের মধ্য দিয়ে নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে একমাত্র তিনিই অর্জন করেছিলেন অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক কৌশল, অসীম সাহস, অবিস্মরণীয় ও দৃঢ় নেতৃত্ব এবং বাগ্মিতা আর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। বঙ্গবন্ধুর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক অর্জনের চূড়ান্ত ফসলই ছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও পরোক্ষ স্বাধীনতা ঘোষণা। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি বহু চাপ, প্রস্তাব, পরামর্শ ও সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে ৭ মার্চের ভাষণে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, এ উপমহাদেশ তো বটেই, এমনকি গোটা দুনিয়ার ইতিহাসেও তা নজিরবিহীন। অনেকেই যাকে আমেরিকান জাতির মহানায়ক আব্রাহাম লিঙ্কনের ঐতিহাসিক ‘গেটিসবার্গ স্পিচ’ সঙ্গে তুলনা করেন। সেদিনের ১৯ মিনিটের ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের মহাকবি, বাঙালির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু বাঙালির হূদয়ে স্বাধীনতার যে বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেদিনের সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে রক্তসে াতে ভেসে ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়েছিল। আমরা পেয়েছি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১ মার্চ থেকে সূচিত অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি পরাধীনতার শৃংখল ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ওই বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে। তথ্য সূত্র: দৈনিক যুগান্তর।