দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বিশ্ব ইতিহাসে এক সমুউজ্জ্বল নাম ফিদেল কাস্ত্রো। ইতিহাসের এমন একজন ব্যক্তির বিদায় ঘটেছে আজ। যার জন্য শুধু কিউবা নয়, পুরো বিশ্বময় শোকে শোকাহত।
কিউবার এই নেতা ফিদেল কাস্ত্রো পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তার রাজনৈতিক জীবন পৃথিবীর মানুষের নিকট ইতিহাস হয়ে থাকবে চিরকাল। তার বিখ্যাত দাড়ি, মুখের চুরুট ও কালচে-সবুজ সামরিক পোশাকের জন্য সারা দুনিয়াময় ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন সবার কাছেই পরিচিত মুখ। অনেক অর্থেই ফিদেল কাস্ত্রো হলেন বিশ্ব-ইতিহাসের একটা সময়ের এক প্রতীকী চরিত্রও।
বিপ্লবী আন্দোলন, স্নায়ুযুদ্ধ, পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের সংঘাত – সবকিছু মিলে গড়ে ওঠা সেই কালপর্ব ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনেরও গল্প ঠিক সেরকমই।
১৯৫৯ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কিউবার তখনকার শাসক বাস্তিতাকে উৎখাত করে কাস্ত্রো টানা পাঁচ দশক ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। পার করেছেন ১০ জন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের শাসনকালও।
ফিদেল কাস্ত্রো এমন এক নেতা ছিলেন যে, আমেরিকার চোখে তিনি ছিলেন যেনো এক স্বৈরশাসক। তাকে কোণঠাসা করতে নানাভাবে চেষ্টা চালানো হয়। কখনও অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, কখনও তাকে এঘরে করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। শুধু তাই নয়, তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যে কারণে তিনি মোকাবিলা করেছেন অন্ততপক্ষে ৬শ ৩৮টি হত্যাপ্রচেষ্টা। আর এসব হত্যা প্রচেষ্টার মধ্যে ছিলো তার চুরুটে বিশ মেশানো হয়েছে। কখনওবা আঁততায়ীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে হত্যা করার জন্য। এভাবে নানা প্রচেষ্টা চালানো হলেও তিনি যেনো অবিচলভাবে টিকে গেছেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, তাঁর শাসনের সময় কিউবাকে তিনি দিয়েছেন প্রথম বিশ্বের সমতুল্য শিক্ষার হার , এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা – যা কিনা অনেক দেশের কাছে ঈর্ষার বস্তু। কিউবানদের গড় আয়ু ও শিশুমৃত্যুর অতি নিম্ন হারও পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তুলনীয়। যদিও তাদের মাথাপিছু আয় উন্নত দেশগুলোর তুলনায় নগণ্যই।
একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ফিদেল কাস্ত্রো লাতিন আমেরিকায় মার্কিন প্রভাব-আাধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন আজীবন। তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন ভেনেজুয়েলার উগো চাভেজ, বা বলিভিয়ার ইভো মোরালেসের মতো নেতাদেরকেও!
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কিউবান স্টাডিজের সম্পাদক ড. স্টিফেন উইলকিনসন বলেছেন, এটা ঠিক যে, কাস্ত্রো কঠোর হাতে তার শত্রুদের দমন করেছেন। তবে এটা মানতেই হবে যে, অন্য অনেক দেশে বিপ্লবের পর যেমন হয়েছে কিউবায় তেমন কোনো রক্তগঙ্গা বয়ে যায়নি, স্তালিনের গুলাগের মতো কিউবায় কোনো শ্রমশিবিরও ছিলো না।
১৯৬১ সালে মার্কিন সমর্থিত বে অব পিগস অভিযানকে পরাজিত করতে পারাটা ছিলো কাস্ত্রোর আরেকটি বড় অর্জন। আফ্রিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে কাস্ত্রোর ভূমিকা সত্যিকার অর্থে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
তেমনি আফ্রিকায় এ্যাংগোলার যুদ্ধে কিউবার ভূমিকা, ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলো। ১৯৮৮ সালে কাস্ত্রো নিজে এমনভাবে সামরিক পরিকল্পনা করেছিলেন- যাতে করে দক্ষিণ আফ্রিকা পরাজিত হয়। তারা এ্যাংগোলা হতে সৈন্য প্রত্যাহার করে এবং নামিবিয়া তখন স্বাধীন হয়।
সে কারণে নেলসন মান্দেলাও বলেছিলেন, তার কারামুক্তি ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পেছনে প্রভাব ফেলেছে ওই যুদ্ধ।
শেষ জীবনে এসে ফিদেল কাস্ত্রো যখন তার ভাই রাউলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন, তার পরেও বিশ্বের বহু দেশের রাজনীতিকরা তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। চাভেজ ও মোরালেসের মতো নেতাদের কাছে কাস্ত্রো ছিলেন এক অনুপ্রেরণা।
চিলির কবি পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক নেতারা অনেক প্রতিশ্রুতি দেন তবে তা পূরণ করতে পারেন খুবই সামান্য। কিন্তু কাস্ত্রো ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, কখনও তাদের চাপে পিছু হটেননি – এই অদম্য চেতনা তার একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো।
কাস্ত্রোও তার স্বপ্নের অনেক কিছুই হয়তো পূরণ করতে পারেন নি, অনেক ক্ষেত্রেই তাকে পেছনে ফেলে সময় এগিয়ে গেছে। তার নীতির সঙ্গে হয়তো সবাই একমত হবেন না, তবে এটা ঠিক যে তিনি তার অঙ্গীকারের প্রতি আজীবনই অনড় ছিলেন।