দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বাংলাদেশী নাগরিকদের পর্যটক হিসেবে মালয়েশিয়া যাওয়া নিয়ে বেশ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে সহযোগী একটি পত্রিকায় বিষদ আলোচনা করা হয়।
আমরা অনেকেই মনে করি পর্যটক হিসেবে বিদেশে বিশেষ করে মালয়েশিয়া যাওয়া আর এমন কিই বা সমস্যা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই পর্যটক হিসেবে ভ্রমণেও নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, মালয়েশিয়া যেতে চাইলে খুব সহজেই ভিসা পাওয়া যাবে। আবার সস্তায় প্লেনের টিকিটও পাওয়া যাবে। দেশের বিমান বন্দরও পার হওয়া যাবে খুব সহজেই। তবে যখনই প্লেন হতে নেমে আপনি মালয়েশিয়ায় ঢোকার জন্য ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াবেন তখনই বুঝতে পারবেন আপনি ভ্রমণে এসে বিপদে পড়তে চলেছেন। পর্যটকের বদলে মুহূর্তে আপনি পরিণত হবেন আসামীতে! তখন আপনার ঠাঁই হবে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরের নীচতলার ইমিগ্রেশন সেলে। সেখানে দু্ই/তিন দিন অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অপরাধীর বেশে ফিরতে হবে নিজ দেশে!
খবরে জানা যায়, ২০ এপ্রিল রাতে কুয়ালালামপুর হতে ঢাকাগামী মালিন্দো এয়ারের একটি ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয় এমন নাজেহালের শিকার ১১ জন বাংলাদেশীকে। ফ্লাইটে যখন তুলে দেওয়া হচ্ছিল তখন যে কারোরই মনে হতে পারে তারা দাগী কোনো আাসামী। ঢাকা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আসলো একজন নিরাপত্তা কর্মী। ঢাকায় ল্যান্ড করার পর তাদের হাতে পাসপোর্ট তুলে দেওয়া হলো। ভাবখানা এমন যে, আগে পাসপোর্টটি তারা হাতে পেলে মনে হয় তারা প্লেনের দরজা জানালা ভেঙে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতেন!
সেদিন এই ১১ জন ‘দাগী আসামীর’ মধ্যে কে ছিলেন তা শুনলে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন। তাদের মধ্যে ছিলেন একজন সম্মানিত বাংলাদেশী নাগরিক। তার নাম আব্দুল মজিদ। পেশায় তিনি একজন প্রকৌশলী। বর্তমানে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের একজন পরামর্শকও। এর আগে তিনি খুলনা এবং রাজশাহী প্রকৌশল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সৌদি আরবেও চাকরি করেছেন জনাব আব্দুল মজিদ। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত আফগানিস্থান পুনর্গঠনে জাতিসংঘের অধীনেও কাজ করেছেন তিনি! সবশেষে আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়াতে তিনি ১৬০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ তত্ত্বাবধান করেছেন। এই আব্দুল মজিদ গিয়েছিলেন মালয়েশিয়া ঘুরতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘোরা তো হয়ই নি বরং বিমান বন্দরে তাকে আসামীর তকমা গায়ে মেখে দেশে ফিরতে হলো। তাঁর সঙ্গে ফিরলেন আরও ১০ জন।
ওই ১০ জনের মধ্যে আরও একজন ছিলেন কুমিল্লার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান। তিনি ব্যবসার কাজে এর আগে অনেকবার বিদেশে গেছেন। তবে এবার ব্যাংকক হতে ফেরার পথে মালয়েশিয়ায় দু চার দিন ঘুরতে গিয়েছিলেন। এই চাওয়টাই কাল হলো তাঁর। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের চোখে তিনিও একজন আসামী হলেন। এজন্য তাকে অনেকটা অপরাধীর বেশে ফিরতে হলো নিজ দেশে! বাকি ৯ জন ‘আসামী’ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেন। তারাও বয়সে তরুণ। অনুমান করা যাচ্ছে তারা মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন কাজের উদ্দেশে। যদি ধরেও নেই যে, তারা ভিজিট ভিসা নিয়ে ওই দেশে অবৈধভাবে থাকতে গিয়েছিলো। তাহলে কেনো তাদেরকে ঢাকার মালয়েশিয়ার দূতাবাস ভিসা দিয়েছে? কেনো ঢাকা বিমান বন্দর হতে তাদেরকে যেতে দেওয়া হলো? যদি আগেই তাদেরকে না করে দিতো তাহলেতো আসামী সেজে তাদেরকে দেশে ফিরতে হতো না। এতো টাকা কেনো খরচ করা লাগলো এই নিরীহ গরীব তরুণদের?
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ৯ তরুণসহ ১১ জন যখন দেশে ফিরলেন তখন দেখা গেলো তাদের সবার হাতেই রয়েছে বৈধ ভিসা, পাসপোর্ট ও রিটার্ন টিকিট! তাহলে তাদের কি অপরাধ ছিলো? কেনো তারা মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না? মালয়েশিয়ায় যদি ঢুকতে দেওয়া নাও হয়, তাহলে কেনো তাদেরকে সসম্মানে পরবর্তী ফ্লাইটে তুলে না দিয়ে ইমিগ্রেশন সেলে আটকে রাখা হলো ২ হতে ৩ দিন? ওই সেলে ঢোকার আগেই সবার কাছ থেকে মোবাইল, হাতের লাগেজ, পাসপোর্টসহ সবকিছুই রেখে দেওয়া হয়। সেলের ভেতরে এক নোংড়া পরিবেশ। সেখানে রয়েছে শত শত বাংলাদেশী। অধিকাংশই পর্যটক ভিসায় মালয়েশিয়া গিয়ে ইমিগ্রেশন সেলে আটকা পড়েছেন। মোবাইল না থাকায় কেও দেশে যোগাযোগও করতে পারেন না। আর তিন বেলা যে খাবার দেওয়া হয় এতোই নিম্নমানের যে অনেকের বমি হয়ে যায়। এই খাবারের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হয় কয়েক হাজার টাকা! যারা টাকা দিতে পারেনা তাদেরকে আবার থাকতে হয় অভূক্ত।
পাশাপাশি রয়েছে সামান্য কারণে মালয়েশিয়া নিরাপত্তা কর্মীদের হাতে কিল ঘুষি চড় থাপ্পর ও লাথি। একজন আসল অপরাধীর সঙ্গেও যা করা যায় না সেই অমানবিক আচরণ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে নিরাপরাধ বাংলাদেশীদের সঙ্গে। এই রকম আচরণ যদি মালয়েশিয়ার কোন নাগরিকের সঙ্গে একবার করা হতো বাংলাদেশে, তাহলে হয়তো দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে টান পড়তো।
এভাবেই বছরের পর বছর মালয়েশিয়ার হাতে নির্যাতিত হচ্ছে বাংলাদেশীরা। কোন রকম প্রতিবাদ নেই বাংলাদেশের। মালয়েশিয়া হতে নির্যাতিত হয়ে প্রতিদিন শত শত বাংলাদেশী দেশে ফিরে আসলেও তা নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা দেখা যাচ্ছে না।
মালয়েশিয়ানদের অমানবিক আচরণকে সরকারও মাথা পেতে মেনে নিচ্ছেন কেনো? আবদুল মজিদের মতো উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের একজন মানুষও যদি মালয়েশিয়া যেতে না পারেন, তাহলে আর কি যোগ্যতা লাগবে ওই দেশে প্রবেশ করতে হলে? আর যদি প্রবেশ নাই করতে পারেন তাহলে কি কারণে তার মতো বয়োবৃদ্ধ একজন সম্মানিত মানুষ ওই দেশের বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন সেলে নিগ্রহের শিকার হলেন? এর কোন উত্তর রয়েছে কারও কাছে?
জানা গেছে, আবদুল মজিদ ঢাকার উত্তরায় থাকেন স্ত্রীকে নিয়ে। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। তাঁর ছেলে কাতার এয়ারওয়েজের প্রকৌশলী। তাঁর মেয়ে থাকেন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। জামাই সেখানে কর্মরত ইউরোপিয় ইউনিয়নের আইটি কনসালটেন্ট! মাত্র কিছুদিন আগে মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আবদুল মজিদ ঢাকা আসতে আসতে ফ্লাইটের মধ্যে ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, জীবনের শেষ ভাগে এসে এমনভাবে অপমাণিত হতো তা কখনও ভাবিনি। দেশে ফিরে স্ত্রীকে নিয়ে আমি ভাবছিলাম মেয়ের কাছে যাবো। মেয়ের কাছে আমি সব কথাই বলি। তবে এই অপমাণের কথা কিভাবে বলবো মেয়েকে তা ভাবতে লজ্জা করছে আমার। প্রশ্ন হলো এই লজ্জা কি শুধু আব্দুল মজিদের? এই অপমান ও অমর্যাদার লজ্জা গোটা বাংলাদেশের মানুষের। এবার চিন্তা করুন আমরা কোন দেশে বসবাস করছি।
# বিশিষ্ট্য সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজের আর্টিক্যাল অবলম্বনে।