ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ ১২ মার্চের বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। রাস্তায় যানবাহন না থাকায় লোকজনের ভোগান্তির শেষ ছিল না। সদরঘাটে কোন লঞ্চ ভিড়তে দিচ্ছে না প্রশাসন ও শ্রমিক লীগের নেতারা। ১১ মার্চ ভোরে নামধারী শ্রমিক লীগ নেতারা বরিশাল থেকে সদরঘাটে আসা কয়েকটি লঞ্চে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্কুল-কলেজে অলিখিত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। টার্মিনালগুলোতে বাস থাকলেও চালক ও হেলপারদের ছুটি দিয়ে দিয়েছেন মালিকরা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় ১১ মার্চ হরতালের আমেজ ছিল পুরো ঢাকায়। আতংকে লোকজন বাসাবাড়ি থেকে কম বের হয়েছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বাসাবাড়িতে পুলিশি তল্লাশি চলছে। যে কোন নাশকতার আশংকায় ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েনের পাশাপাশি চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চলছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ ও র্যাব তল্লাশির নামে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে। তারা নিরপরাধ লোকজনকে ধরে নিয়ে বিভিন্ন মামলা ঠুকে দিচ্ছে। পিকআপ ও মাইক্রোবাস রিকুইজিশন করছে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, সমাবেশে ডিউটি করতে গাড়ি রিকুইজিশন করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।
বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, বিরোধী দলের মহাসমাবেশ বানচাল করতে সরকার কোন চেষ্টাই করছে না। বরং বিরোধী দলই সরকারকে কোন সহযোগিতা করছে না। রাস্তায় বাস না চলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। সমাবেশের নামে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে বলে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
রাজধানীতে অঘোষিত হরতাল!
গত এক মাস ধরে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছিল। দুই শিবিরের নেতাকর্মীরা একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালান। আবার মন্ত্রী-এমপিরাও তা থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। এ নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যায় সাধারণ মানুষ। গত কয়েকদিন ধরে পুলিশ ও র্যাবের যানবাহনে তল্লাশি ও গণগ্রেফতার নিয়ে জনমনে দেখা দেয় আতংক। তাছাড়া সরকার হঠাৎ করেই দূরপাল্লার যানবাহন ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় নেমে আসে জনদুর্ভোগ। এরই জের ধরে ১১ মার্চ ও আজ ১২ মার্চ পুরো রাজধানীতেই অঘোষিত হরতাল। নগরীর দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত খোলা থাকলেও পাবলিক পরিবহন ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। রিকশা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং কিছু কিছু সিএনজি অটো রিকশা ছাড়া রাস্তায় তেমন কোন যানবাহন চলাচল করেনি। মূলত ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ এবং নানামুখী চাপে রাজধানীর পাবলিক পরিবহন বন্ধ রাখা হয়। ফলে নগরবাসীকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। হাজার হাজার মানুষকে বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, শ্যামলী, ধানমন্ডি, মতিঝিল, গুলিস্তান, গাবতলী, মিরপুর, কল্যাণপুরসহ নগরীর আরও কিছু এলাকা ঘুরে মিলেছে এমন চিত্র। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় আসতে বিএনপি-জামায়াতের রিজার্ভ করা যানবাহনগুলোও প্রশাসন আটকে দিয়েছে। ১০ মার্চ রাত থেকেই গ্রেফতার আতংকে রাস্তায় সাধারণের চলাচল উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তবে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের নেতাকর্মীদের ভিড় জমেছে সকাল থেকেই। রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোতেও পরিচিতজন ছাড়া কাউকে সিটভাড়া দেয়া হচ্ছে না। ১১ মার্চ রাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় আসা লোকজন হোটেলে উঠতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন। তাদের মধ্যে যারা কোনভাবে পরিচয় দিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করতে পেরেছেন কেবল তারাই ঠাঁই পেয়েছেন। বাকিরা শেষ পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজনের বাসা-বাড়িতে ওঠে রাত কাটিয়েছেন।
নাশকতার আশংকা
বিএনপির এ কর্মসূচিকে ঘিরে বড় ধরনের নাশকতার আশংকা করছে সরকার। সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিএনপির কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতারাও বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। এ জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান রাজধানীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলেছে। সবখানে সাধারণ পথচারী থেকে শুরু করে সব ধরনের গাড়ি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তল্লাশি করা হচ্ছে। যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাকেই গ্রেফতার করছে পুলিশ। ঢাকার সবগুলো রাস্তার দৃশ্যপট অন্যদিনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফাঁকা রাস্তা। রাস্তার পাশে শুধু মানুষ আর মানুষ। সকালে অফিসমুখী অনেককেই পায়ে হেঁটে অফিসে যেতে দেখা গেছে।
দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন
রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ঈশ্বরদী, রংপুর, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর বাস কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে না। এসব টার্মিনালে সারি সারি বাস অবস্থান করছে। কোন গাড়িই চলছে না। অসংখ্য যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে গন্তব্যস্থানে যেতে। এ ব্যাপারে হানিফ পরিবহনের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে লিখিত কোন নির্দেশ না এলেও মৌখিক নির্দেশ এসেছে। তাছাড়া নিরাপত্তাজনিত এবং গণহারে গাড়ি রিকুইজিশনের কারণে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা রাস্তায় গাড়ি নামাচ্ছেন না। ভাংচুরের আশংকায় বিআরটিসির গাড়িগুলো ডিপো থেকে বের হয়নি। ঈগল পরিবহনের কর্মকর্তা লুৎফর রহমান জানান, দুর্ঘটনা এড়াতে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ১০ মার্চ রাতে বরিশাল থেকে তাদের কোন বাস ঢাকার পথে ছাড়েনি। বরিশাল থেকে কোন পরিবহনের বাস ১১ মার্চ ও ১২ মার্চ ঢাকায় আসবে না। বাস মালিকরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে তারা রাস্তায় বাস নামাতে নির্দেশ দিচ্ছেন না। অতীতেও দেখা গেছে, বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে পরিবহনের ওপর হামলা ও জ্বালাও পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটে। এই কারণে আমরা আতংকের মধ্যে আছি। আবার সরকারের চাপও আছে। সবমিলিয়ে আমরা হয়ে যাচ্ছি ‘খেলার পুতুল’। গাবতলী-সায়েদাবাদ রুটের এক বাসচালক রুহুল আমিন জানান, সকালে বাস বের করেছিলাম। কিন্তু টেকনিক্যালে কয়েকটি গাড়ি শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীরা ভেঙে দেয়। বেশ কিছু বাস নিয়েও গেছে। এরপর থেকে বাস বন্ধ।
সদরঘাটে যাত্রীদের ওপর হামলা
সদরঘাটে যাত্রীদের মারধর ও ধাওয়া করেছে লাল শালুপরা সরকার সমর্থক ৪০/৪৫ জনের একটি দল। তারা দল বেঁধে লাঠিসোটা নিয়ে সদরঘাটে লঞ্চ ভিড়তে বাধা সৃষ্টি করে। এ সময় কেউ কেউ লঞ্চে উঠে যাত্রীদের ওপর হামলা চালায়। তাদের হামলায় মহিলা ও শিশুরা আতংকিত হয়ে পড়ে। দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীবাহী কয়েকটি লঞ্চ ভোরে টার্মিনালে ভিড়লে পুলিশের উপস্থিতিতেই এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।