দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মানবিকতার চরমতম এক বিপর্যয় হলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম। তারা গত কয়েক যুগ ধরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার শিকার হয়ে আসছেন। ঘর-বাড়ি হারিয়ে আজ তারা এক যাযাবরের মতো জীবন যাপন করছেন।
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে সেটি মনে হয় বিশ্বের অন্যকোনো দেশে করা হয়নি। নিজ জন্মস্থানেও যে ঘর-বাড়ি হারিয়ে নদী পার হয়ে অন্যদেশে পাড়ি জমাতে হবে সেটি বোধহয় কারও কাছেই কাম্য ছিল না।
শত শত বছর ধরে আদি নিবাস ছিল এই রোহিঙ্গাদের। কিন্তু একমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণেই কি তাদের এই পরিণতি? সেই প্রশ্ন এসে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণই হলো বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাওকে তাড়িত করবে তাতে সন্দেহ নেই। উপমহাদেশ এবং পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে ক’টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য হলো তারমধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা হলেন সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এই আরাকান রাজ্যে এক সময় স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
আজকের কথা নয় ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন ২শ’ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়েছিল। ১৬৩১ সাল হতে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। এরপর সেখানে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুরতম ও অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে ৩শ’ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।
এরপর ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেন। তিনিও ছিলেন ঘোর মুসলিম বিরোধী। আর তাই বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকেন। এরপর ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়।
১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপকভাবে রূপ নেয় ও তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিমকে হত্যা করে। এরপর ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। তবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো রকম পরিবর্তন ঘটেনি। তার পরও রোহিঙ্গা মুসলিমরা থেকে যায় ভাগ্য বিড়ম্বিত। স্বাধীন দেশের সরকার তাদেরকে নাগরিকত্বতো দূরে থাক মানবিক অধিকারটুকু থেকেও করেছে বঞ্চিত!
এরপর থেকে নাসাকা বাহিনী এবং বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তাইতো আজ রোহিঙ্গারা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক।
১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেন। সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে শুধুমাত্র ‘বসবাসকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়! তাদের কোনো ভোটাধিকার নেই। নেই কোনো সাংবিধানিক এবং সামাজিক অধিকারও। নিজ দেশে তারা পরবাসী! তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতেও পারে না! এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ সেখানে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রাখাইন বৌদ্ধদের সেখানে এনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে।
সেখানে যুগ যুগ ধরে মুসলিম নিধনের ধাবাহিকতা চলে আসছে। ২০১২ সালের ৩ জুন হতে পূর্ব পরিকল্পিত ইতিহাসের নৃশংসতম এক গণহত্যা শুরু করেছে সন্ত্রাসী রাখাইন বৌদ্ধরা। রোহিঙ্গাদের হাতে বৌদ্ধ মহিলা নির্যাতনের অজুহাতে তারা এই গণহত্যার সূচনা করে। শুরুতেই কট্টরপন্থী সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা অন্তত ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে শহীদ করে। তারপর হতে প্রতিবছরই কোনো না কোনো অজুহাত খাড়া করে চালানো হয়েছে নির্যাতন। গত বছরও একবার এই ধরনের হামলা করে হাজার মুসলমানের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার এ মাসে শুরু হয় আবার সেই হত্যাযজ্ঞ। একের পর এক মুসলিম হত্যা এবং তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকারগুলো তীব্র নিন্দা করলেও মিয়ানমার সরকার এক কথায় নিশ্চুপ রয়েছে। যে সুচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল সেই সুচি আজ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। তার এই নীরবতা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদের কর্মকাণ্ড অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। এক মহা মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে সেখানে। হাজার হাজার লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম চরমতম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের উপর এই অকত্য নির্যাতন হতে দেওয়া যায় না। আজ শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বনিতা কেওই রেহাই পাচ্ছে না এই বর্বরতার হাত থেকে। বিশ্ববাসীকে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আর মিয়ানমার সরকারের এহেন অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতে হবে।