দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মমি তৈরির পেছনের ইতিহাস কি? এটি কি সত্যি খুব চমকপ্রদ? নাকি আত্মাদের ভয়ংকর কোন পুনঃজাগরণ! নাকি মমি হাজার বছরের পুরনো প্রাচীন মিশরীয় জীবন এবং সংস্কৃতি! কিংবা এটি কি হলিউডের গা শিহরিত করা সেই চলচিত্র যেখানে মৃত মমিরা ফিরে এসেছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবং পুরো পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে? কারন যাই হোক না কেন, মমি এবং তাদের গল্পগুলো ইতিহাসের অত্যাবশ্যক অংশ।
এখন পর্যন্ত অনেক লোক তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে গবেষণার মাধ্যমে সেই সকল রহস্যময় উত্তর বের করার জন্য যা প্রাচীন মিশরীয়রা রেখে গেছে। মমির উপর গবেষণা করে ইতিহাসবিদরা জানতে সক্ষম হয়েছে প্রাচীন মিশরীয়দের জীবন-যাপন, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং আরো অনেক কিছু।
বাস্তব মমির কাহিনী এক রকম হলেও হলিউডের মমি কাহিনী গুলো চলচিত্রের প্রয়োজনেই অনেকটা বিনোদনমূলক করে তৈরি করা হয়েছে। তবে হলিউডের চলচিত্রের কাহিনী সমূহের পেছনের গল্পগুলো কিছুটা সত্য।
এদিকে ইতিহাসের গবেষণা থেকে জানা যায় একটি মমি যার মগজ বের করে নেয়া হয় শুরুতেই। মমির মগজবিহীন দেহ যা কাপড় দ্বারা মোড়ানো থাকে এবং তা সমাধিস্ত করা হয় পিরামিডের ভেতর একটি যুগের অভিনব প্রকস্টে। তবে সাধারণ নিয়মের বাইরেও মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করার অনেকগুলো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করা শুধুমাত্র এই নয় যে দেহকে কোথাও স্থাপন করা বরং এটি একটি শ্রমসাধ্য, জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া যা প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে আমরা দেখবো কিভাবে এবং কেন মৃতদেহ মমিতে পরিণত করা প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং মৃতদেহ মমিতে পরিণত করার প্রক্রিয়া।
প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম ছিল বহু ঈশ্বরবাদী অর্থাৎ তারা অনেক দেবতায় বিশ্বাসী। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পরের জীবনে। পাতালদেশে (তুত) বিচার করা হত মানুষের আত্মার যেখানে তাদের গ্রহন করা হত বিচারের জন্য। দুইজন প্রধান দেবতা তুতের একজন “রা” নামে পরিচিত যিনি সূর্য দেবতা আর অপরজন “অসিরিস” প্রেতলোকের দেবতা। তুতে অর্থাৎ পাতালদেশে প্রবেশ করার পূর্বে সকল মৃত আত্মাকে দেবতাদের বিচারের মুখোমুখি করা হতো।
অসিরিস, সেথের হাতে খুন হওয়ার পর আবার জীবন ফিরে পেয়েছিলেন আইসিস দেবতার জাদু আর শক্তির মাধ্যমে। এই পুনরত্থানের মাধ্যমে আইসিস এবং অসিরিস দুজনেই একসাথে পার্থিব পৃথিবীর উত্তরাধিকার হতে পারতো কিন্তু মৃত্যুর ফলে অসিরিস পৃথিবীর রাজত্ব হারায়। অপরদিকে পাতালদেশের দেবতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অসিরিস আত্মাদের বিচার করতো তাদের ভালো কাজ, দানশীলতা, ধার্মিকতা, শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান উদযাপন, কথার বিশ্বাস আর প্রার্থনার উপর ভিত্তি করে। অনেকে বিশেষ করে গরিবরা যাদের পক্ষে এই ধরনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা সম্ভব ছিল না তারাও বিদ্বেষপূর্ণ শাস্তি পেত। তুতের অনেক গুলো স্তরের মধ্যে তাদেরকে প্রবেশ করানো হতো সবচেয়ে প্রথম স্তরে। বিদ্বেষী আর দেবতারা এর অপুজারীদের শাস্তি দেওয়া হতো অগ্নিসদৃশ পাথর দ্বারা। অসিরিস তাদেরকে পাথরের শাস্তি দেওয়ার পূর্বে তার দেবী নিফিস তাদেরকে নৃশংস শাস্তি প্রদান করতো।
রা, সূর্য দেবতা এবং প্রাচীন মিশরীয়দের সৃষ্টিকর্তা আত্মার প্রহরি দ্বারা সজ্জিত হয়ে নৌকায় করে তুতের পূর্ব দিগন্তের স্বর্গে প্রবেশ করতেন। রা দেবতার সাথে নৌকায় করে আসা ধর্মনিষ্ঠ আত্মাদের বিবেচনা করা হতো স্বর্গবাসী আর বিদ্বেষীদের প্রেরন করা হতো শাস্তির জন্য নরকে। রা আত্মাদের রাতের বেলা তুতের মধ্যে বিভিন্ন অনিষ্টর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিজের সাথে বহন করতো। সূর্যোদয়ের সময় তিনি তাদের মুক্ত করে দিতেন স্বর্গের পূর্ব দিগন্তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল এই কারনেই সূর্য উঠে এবং অস্ত যায়। রা আত্মাদের সাথে সূর্যকেও বহন করতো। রা এর সকালের নৌকাকে বলা হতো “মেতিত” যার অর্থ ছিল শক্তিশালী হও আর রাতের নৌকাকে বলা হতো “সেমতিত” যার অর্থ দুর্বল হও। দেবতা রা তার মেতিতে করে আত্মা আর সূর্য কে স্বর্গে আনতেন ফলে তৈরি হতো সূর্যোদয়। আর আত্মা আর সূর্যকে সেমতিত দিয়ে নিয়ে যেতেন তুতে ফলে তৈরি হতো সূর্যাস্ত এবং রাত। রাতের বেলা যখন দেবতা রা পাতালদেশ ঘুরে বেড়াতেন তখন তিনি আত্মাদের শান্তি দেখে আনন্দ অনুভব করতেন।
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর তাদের দেহ সংরক্ষন করা গুরুত্বপূর্ণ মৃত্যুর পরের জীবনে আত্মাদের লাভবান হওয়ার জন্য। “খাত” বা দেহ বলতে বুঝানো হতো আত্মা সেখানে বসবাস করে। আত্মার অনেক ধরনের বিমূর্ত ব্যক্তিত্ব রয়েছে। “কা”(মন) আবাস দেহ মানে “খাত” যেটি মূলত দেহে অধিষ্ঠিত হয় স্বর্গ থেকে দেবতার মাধ্যমে। অপরদিকে “বা” (আত্মা) “খাইবিত” যা মানসিক দেহ এবং “সেকহাম” বা আত্মার প্রাণশক্তি অবতীর্ণ হয় বিচারের জন্য রা এবং অসিরিসের সামনে পাতালদেশে বা তুতে। সকল আত্মিক দেহ একে অপরের সাথে পরস্পর সংযুক্ত আর নির্ভরশীল। কারন এই আত্মাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা মুক্তহস্তে হয়ে থাকে খাদ্য, পানীয় আর বস্তু দ্বারা, যা মূলত প্রকাশিত হয়ে থাকে মনিরত্ন, অস্ত্র, আসবাসপত্র এবং যুদ্ধরথ সমাহিত করা হতো লাশের সাথে। কিছু কিছু সমাধিতে অতিরিক্ত কক্ষ তৈরি করা হতো নৈবেদ্যর জন্য, যেন খাদ্য আর পানীয় সংকট না হয় আত্মাদের। দেহকে সমাধিস্ত করার পর পুরো কক্ষটি বিভিন্ন গঠনশৈলী আর চিত্রাঙ্কনে সাজানো হতো এই জন্য যে বিশ্বাস করা হত মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এটি আত্মাদের বাস্তবতার আস্বাদ দিবে। গঠনশৈলী আর চিত্রাঙ্কনে স্থান পেত প্রার্থনা, মন্ত্র আর ধর্মীয় খোদাই।
শারীরিক দেহকে মমিতে পরিণত করা মিশরীয় ধর্মের একটি প্রধান অংশই ছিল। মমি তৈরি করার এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করে। ঐতিহাসিক ভাবে এটি ছিল মরুভূমিতে অগভীর স্থানে গর্ত করে তাপ আর কাদা থেকে রক্ষা করা। পরবর্তীতে উচ্চবিত্তের মিশরীয়রা কুঠুরি নির্মাণের মাধ্যমে সমাহিত করার পদ্ধতি চিন্তা করেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যখন সংরক্ষনের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে তখনি এটি ভালোভাবে উন্নতি লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে শুরু হয় উন্নত ধরনের মমি তৈরি করা। সবার প্রথম এবং সবচেয়ে উন্নত কিন্তু ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া হল বাঁকানো লোহার রড দিয়ে সজোরে মাথার ভেতর থেকে মগজ বের করে এনে নাক ও মাথার কঙ্কালটি এক ধরনের ওষুধ দিয়ে আলতোভাবে ধুয়ে ফেলা। তারপর পেট কেটে তালের ওয়াইন দিয়ে ধুয়ে ফেলা আর সুগন্ধি পুরে দেওয়া। এছাড়াও পাকস্থলি গহ্বর বিভিন্ন গন্ধরস পণ্যদ্রব্য দ্বারা রেখে দেওয়া হয়। মৃতদেহ পুরোপুরি পরিস্কার করার পর দেহ কে সুগন্ধিময় আঠা আবৃত লিনেন কাপড় দ্বারা পায়ের তালু থেকে মাথা পর্যন্ত প্যাঁচানো হয়। তারপর কিছুদিন পর মৃতদেহকে শবাধারে স্থানান্তরিত করা হয় সম্মানের সহিত। শবাধারটি মানব দেহের আকৃতিতে তৈরি হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ব্যয়বহুল খরচটি হয় শবাধারে স্থানান্তরের পর, সিডার গাছের তেল সিরিঞ্জের মাধ্যমে পেটে প্রবেশ করানো হয়। এটি পেটের ভেতরের সকল অঙ্গ এবং মাংস গলিয়ে ফেলে শুধুমাত্র ত্বক আর হাড় ছাড়া। মমি করার তৃতীয় পর্যায়ে অন্ত্র থেকে সব বের করে আনা হয় এবং দেহকে সুবাসিত বস্তু দ্বারা পুরোপুরি আবৃত করে ফেলা হয়। এভাবেই মমি করার প্রক্রিয়াটি শেষ হয়, শবাধারটিকে গোপন কুঠুরিতে পুরে দেওয়া হয়।
ইতিহাসবিদ এবং গবেষকরা মনে করেন প্রাচীন মিশরিয়দের জীবনযাত্রায় মিশে ছিল দেবতার প্রতি আনুগত্য, সামস্টিক প্রার্থনা, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কল্পনা আর নৈতিক দৃষ্টিকোণ। মিশরীয়রা আমাদের দেখিয়েছে মৃত্যু হল মরণশীলতা আর অমরণশীলতার উত্তরনের একটি বিন্দুমাত্র। যেখানে একটা স্তরে তারা প্রস্তুতি নিবে পরবর্তী স্তরের জন্য, তারা বিশ্বাস করতো মৃত্যু পরবর্তী জীবনে দেবতার কাছে তাকে থাকতে হবে, যে জীবনের কোন শেষ নেই।
প্রধান সূত্রঃ Humanities360
This post was last modified on ফেব্রুয়ারী ৬, ২০১৪ 12:13 অপরাহ্ন
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ইসলামিক সঙ্গীত জগতে এক নয়াদিগন্তের সূচনা করলেন হোসাইন নূর। তার…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দু’টি কচ্ছপ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন এক তরুণী। কচ্ছপ…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শুভ সকাল। রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ খৃস্টাব্দ, ৭ পৌষ ১৪৩১…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ফিটনেস প্রশিক্ষকরা বলেছেন, হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো, জগিং, সাইকেল চালানো কিংবা সাঁতার…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ প্রায় একযুগেরও বেশি সময় পর মৌলিক গান নিয়ে মিউজিক ডোমেইনে…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ১৯৫১ সালের নভেম্বর মাসে বিয়ে হয় ফে ও রবার্টের। বিয়ের…