ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) পদ্ধতি নিয়ে জনগণের মধ্যে যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে তা এখনও কাটেনি। এই পদ্ধতির পৰে বিপৰে নানা মত নানা জনের। এই পদ্ধতি নিয়ে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বন্দ্ব সম্প্রতি চরম আকার ধারন করেছে।
নারায়ণগঞ্জ ও কুমিলৱা সিটি নির্বাচন এবং নরসিংদী পৌর নির্বাচনের বকেয়া পাওনা, ইভিএমের ব্যাটারি ক্রয় সংক্রান্ত প্রস্তাবনা, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে প্রটোটাইপ মেশিন তৈরির প্রস্তাবনা নিয়ে কমিশন এবং বুয়েটের অবস’ান বিপরীতমুখী। এ অবস’ায় আসন্ন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বুয়েট থেকে এ অনিশ্চয়তার বিষয়ে কমিশনকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বুয়েটের পাওনা টাকা দিতে কমিশনকে সম্প্রতি কড়া ভাষায় চিঠিও দেয়া হয়েছে।
বিরোধী দলের আপত্তি
ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে বিরোধী দল বিএনপি আগাগোড়ায় আপত্তি করে আসছে। বিএনপি’র মতে, এই পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া বিএনপি মনে করে, বর্তমান সরকার এই পদ্ধতিতে কারচুপির আশ্রয় নিতে পারে। তাছাড়া একটি সমস্যার কথা বলা হয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত তারা এই পদ্ধতি কতখানি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সমর্থ হবে।
সরকারি দলের বক্তব্য
ইতিমধ্যে দুটি নির্বাচনে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে তেমন কোন অভিযোগ কেও উঠায়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের কথা উলেৱখ করে বর্তমান সরকারের এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলু বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট দান সম্পন্ন হলে আমাদের দেশে বাধা কোথায়? আধুনিক বিশ্বে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করলে সমস্যা কোথায়। শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এমপি আরও বলেন, আমাদের দেশে কোন কিছু প্রথমে প্রবর্তন করলে জনগণ তা স্বাভাবিক ভাবে নিতে চান না। তিনি এ বিষয়ে একটি উদাহরণ টেনে বলেন, আমার এলাকায় একটি পাকা রাস্তা করা হলে এলাকার এক বয়জেষ্ঠ মানুষ ওই রাস্তায় হোচট খেয়ে পড়ে যান। তখন তার পায়ের নখ উলটে যায়। তিনি খেপে গিয়ে বলেন, এমপি সাহেব আসুক রাস্তা বানানো শেখাবো। এমপি মহোদয় আরো বলেন, তখন মানুষ বুঝতো না পাকা রাস্তা কি। এখন মানুষ পাকা রাস্তা করার জন্য আমার কাছে আসেন। তিনি বলেন, ইভিএম পদ্ধতি কি এখন মানুষ বুঝতে পারছে না। একদিন আসবে তখন মানুষ এই পদ্ধতির জন্য আন্দোলন করবে।
ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনার
ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহনেওয়াজ সম্প্রতি বলেছেন, এখন ইভিএম ব্যবহার নিয়ে শংকিত হওয়ার কোন কারণ নেই। এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। যেসব বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহসা সমাধান হয়ে যাবে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ডিসিসি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসার পরিকল্পনা হয়েছে বলে জানান তিনি। এসব বিষয়ে একটু সময় নিয়ে কমিশন এগো”েছ বলে মন্তব্য তার।
বুয়েটের পাওনা প্রসঙ্গ
নারায়ণগঞ্জ ও কুমিলৱা সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কয়েক মাস ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। নরসিংদী পৌরসভার মেয়র পদে উপনির্বাচন হয়েছে সর্বশেষ ১৯ জানুয়ারি। এসব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়। ইভিএম ব্যবহারে প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহায়তা করে বুয়েট। এ তিনটি নির্বাচনে বুয়েটের পাওনা ৫৫ লাখ টাকা এখনও পরিশোধ করেনি ইসি। এ অবস’ায় পাওনা পরিশোধে বুয়েটের আইআইসিটি বিভাগ থেকে সম্প্রতি কমিশনকে কঠোর ভাষায় চিঠি দেয়া হয়েছে। পাওনা পরিশোধ না করায় তারা বিব্রতকর পরিসি’তিতে পড়েছে বলে চিঠিতে জানানো হয়।
ডিসিসি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গ
বুয়েট জানায়, ডিসিসি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে জর্বরি ভিত্তিতে ১২শ’ ব্যাটারি ক্রয় করতে হবে। প্রতিটি ব্যাটারি ১২শ’ টাকা দরে এ খাতে লাগবে ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কমিশনের দোটানা মনোভাবের কারণে এ বিষয়ে বৈঠক করেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তারা। অথচ বুয়েট ব্যাটারি কেনার টাকা চেয়ে চিঠি দেয় প্রায় এক মাস আগে। এ ব্যাটারি আনতে হবে চীন থেকে। আগামী মে’তে বিভক্ত ডিসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এখন ব্যাটারি কেনার টাকা দেয়া হলেও ডিসিসি নির্বাচনের আগে চীন থেকে তা এনে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না বলে বুয়েটের একজন অধ্যাপক ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। এ অবস’ায় ডিসিসিতে ইভিএম ব্যবহার পুরোপুরি অনিশ্চিত। ১২শ’ টাকা দামে কমিশন ব্যাটারি ক্রয় করবে না বলে সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে তারা।
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গ
সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সম্প্রতি বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ইভিএম প্রস’ত করে রাখা হবে। কিন’ বাস্তব চিত্র এর বিপরীত। গত কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইভিএমের প্রটোটাইপ তৈরিতে ২ কোটি টাকা চেয়ে প্রস্তাব দেয় বুয়েট। বুয়েট জানায়, এ প্রটোটাইপ তৈরিতে সময় লাগবে ৬ মাস। দ্র্বত প্রটোটাইপ তৈরির কাজ শুর্ব না হলে জাতীয় নির্বাচনের আগে দুই লাখ ইভিএম তৈরি সম্ভব নয় বলে জানায় বুয়েট। আগামী বছরের জুনের মধ্যে ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা ছিল বুয়েট ও বিগত ইসির। কারণ পরীক্ষার জন্য জাতীয় নির্বাচনের কমপক্ষে ৬ মাস আগে ইভিএম তৈরি সম্পন্ন করতে হবে বলে জানিয়েছিল বুয়েট। কিন’ এ কমিশন দায়িত্ব নেয়ার দেড় মাস হতে চললেও প্রটোটাইপ মেশিন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করতে পারেনি। এমনকি বুয়েটের দেয়া প্রস্তাব কমিশন বৈঠকেও ওঠেনি। নতুন কমিশন বলছে, মে’তে ডিসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ইভিএম নিয়ে আবার দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে। কিন’ বুয়েটের সংশিৱষ্টরা জানান, ইভিএম প্রটোটাইপ না হলে ব্যাপকভিত্তিক ইভিএম তৈরি সম্ভব নয়। প্রটোটাইপ তৈরিতে এবছর পার হয়ে গেলে আগামী বছরের ৫-৬ মাস সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় দুই লাখ ইভিএম তৈরি কিছুতেই সম্ভব নয়। এ পরিসি’তিতে কমিশন যেভাবে এগো”েছ তাতে আগামী নির্বাচনের আগে ইভিএম তৈরি যে সম্পন্ন হ”েছ না তা এক রকম নিশ্চিত বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এসব টানাপোড়েনের মধ্যে একজন আবদুল মজিদের সঙ্গে বিকল্প ইভিএম তৈরির ব্যাপারে রোববার বৈঠকে বসতে যা”েছ ইসি। ব্যক্তি আবদুল মজিদের তৈরি মেশিন যুগোপযোগী না হওয়ায় বিগত কমিশন বিদায়ের আগে তার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। একই বিষয়ে এ কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের মতো গুর্বত্বপূর্ণ প্রশ্নে একই ব্যক্তির সঙ্গে কেন আলাপ করছে তা বোধগম্য হ”েছ না ইসির কর্মকর্তাদের। এই ব্যক্তি মজিদ দীর্ঘদিন থেকে কমিশনকে কম দামে ইভিএম দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আসছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
পরিসি’তি যায় হোক না কেনো ইভিএম পদ্ধতির ব্যাপারে নতুন নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেহেতু বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে, এৰেত্রে পজিটিভ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় হবে বুদ্ধিমানের কাজ।