দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বহুল আলোচিত গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেনের বিরুদ্ধে র্যাবের দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মামলা প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়।
একদিন লিমনের দু’পা দিয়ে হেটে বেড়াতেন। বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়া-দৌড়ি করতেন। কিন্তু ছোট্ট একটি ঘটনা লিমনের জীবনকে আজ দুর্বিসহ করে তুলেছে। নির্দোষ হয়েও অপরাধীদের মতো তার সঙ্গে আচরণ করা হয়েছিল। আর সে কারণেই তাকে হারাতে হয়েছে একটি পা। মানুষের জীবনে এর থেকে আর দুর্ভাগ্যের কি হতে পারে। তবুও এটুকু শান্তনা লিমন পেয়েছেন, রাষ্ট্র আজ বুঝতে পেরেছে, তার সঙ্গে সেদিন যা করা হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণই ভুল। যার মাশুল সারা জীবন তাকে দিতে হবে।
দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করেন, বহু আগেই সরকারের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সরকার তা করেনি। এরই মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে। তবুও শেষ সময়ে সরকারের এ বোধোদয়কে স্বাগত জানিয়েছেন তারা।
গতকাল ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, লিমনের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে অস্ত্র আইনে ও সরকারি কাজে বাধার অভিযোগে করা দুটি মামলায় লিমনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। ১ জুলাই অস্ত্র মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেন ঝালকাঠির বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। লিমনকে ঘিরে নানা নাটকের পর শেষ পর্যন্ত মামলা প্রত্যাহার হলো। এর পরই লিমন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়েছে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করায় আমি খুশি।’
মামলা প্রত্যাহারের পর এবার লিমনের পা হারানোর জন্য দায়ী র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। র্যাব লিমন ও তার সঙ্গীদের যে অবস্থায় পেয়েছে, তাতে তারা র্যাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছিল। প্রতিরোধের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে।’
এদিকে মামলা প্রত্যাহারের খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমন হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যরা। তিনি মনে করেন, এর মধ্য দিয়েই প্রমাণ হয়েছে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। এখন অভিযুক্ত র্যাব সদস্যদের বিচার হলেই তিনি ‘প্রকৃত বিচার’ পাবেন। র্যাবের মামলা বিষয়ে লিমন সাংবাদিকদের বলেন, “যেহেতু তারা আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে, তাই তাদের বিচার হতে হবে। আমি সব র্যাবকে বলছি না, যারা এর সঙ্গে জড়িত শুধু তাদের বিচার চাই আমি।”
লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা দুটি প্রত্যাহারের জন্য অনেকদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। গতকাল মঙ্গলবার কমিশনের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিশনের চেয়ারম্যানের ৩০ মের চিঠি, সরাসরি সাক্ষাৎ ও অনুরোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই ফোন করে কমিশন চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সরকার, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানিয়েছে কমিশন।
এর আগে ২৩ জুন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তার কার্যালয়ে লিমন, তার মা হেনোয়ারা বেগম ও বাবা তোফাজ্জেল হোসেনকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। এ সময় তিনি র্যাবের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের বিপরীতে র্যাবের বিরুদ্ধে লিমনের মায়ের করা মামলা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
উল্লেখ্য, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা লিমন ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির কাছের মাঠ থেকে গরু আনতে যায়। পথে স্থানীয় শহীদ জমাদ্দারের বাড়ির সামনে র্যাব-৮-এর একটি দল তাকে আটক করে। এ সময় তিনি নিজেকে কাঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলে পরিচয় দেন। কিন্তু র্যাবের এক সদস্য লিমনের কথা না শুনেই তার বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। পরে তার গুলিবিদ্ধ বাঁ পা কেটে ফেলেন চিকিৎসকরা।
এ ঘটনার পর র্যাব-৮-এর তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) লুৎফর রহমান বাদী হয়ে লিমনসহ আটজনের বিরুদ্ধে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করেন। অন্যদিকে র্যাবের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন লিমনের মা। কিন্তু তদন্তের পর মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) দেয় পুলিশ। এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করলে সেটাও খারিজ করেন ঝালকাঠির ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। পরে এ আদেশের বিরুদ্ধে জজ আদালতে রিভিশন দায়ের করেন লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম।