দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর হলো আটলান্টিক মহাসাগর। এর ঠিক মধ্যখানে জেগে রয়েছে ৯টি দ্বীপ। ম্যাপে খুঁজতে গেলে মনে হবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চালের দানা। শতবর্ষী পোস্টঅফিসের অবস্থান মহাসাগরের মধ্যে!
আসলে কতোটা গভীর সাগরে বুঝতে চাইলে আপনার মাথায় রাখতে পারেন, এই দ্বীপ থেকে যে কোনো দেশে গিয়ে উঠতে চাইলে আপনাকে পারি দিতে হবে অন্ততপক্ষে ২ হাজার মাইল পথ।
পর্তুগালের মালিকানাধীন এই দ্বীপগুলোকে একসঙ্গে বলা হয়ে থাকে ‘আজোরেস দ্বীপপুঞ্জ’। চারিদিকে অথৈ পানির মাঝে ভেসে থাকা এই দ্বীপপুঞ্জ হলো বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক উত্তপ্ত ঝরণা, ইউনেস্কো ঘোষিত ৩টি সংরক্ষিত জীবমন্ডল ও বিশ্বমানের তিমি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র; এসবের মোহে পড়েই দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন বহু পর্যটক। এই দ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছেই, পর্তুগিজ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দ্বীপপুঞ্জটিতে ঘুরে গেছেন অন্ততপক্ষে ২০ লাখ দর্শনার্থী।
এই দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপই হলো ফায়াল। এখানে বসবাস করেন ১৫ হাজার মানুষ। দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে অন্যতম ছোটদ্বীপ হলেও এখানকার জীবনযাত্রা অনেক উন্নত। এখানেই রয়েছে দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রবন্দর হলো হোর্টা। তবে এই দ্বীপপুঞ্জটি দর্শণার্থীদের কাছে আলাদাভাবে আকর্ষণের কারণ হলো এখানকার পুরনো একটি পাব ও ডাকঘর। ‘পিটার ক্যাফে স্পোর্ট’ নামে পাবটি বিশ্বের অন্যতম এবং প্রাচীন মদের বার। ১৯১৮ সালে এনরিক আজেভেদো নামের একজন খেলা পাগল মানুষ তার ছেলের নামে বারটি চালু করেছিলেন। ক্রমেই এটি নাবিকদের যাত্রা বিরতির অন্যতম স্থান হিসেবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিলো। আমেরিকা থেকে যারা সমুদ্র পথে ইউরোপ যান তাদের জন্য পিটার ক্যাফে স্পোর্ট হয়ে ওঠে অন্যতম আকর্ষণ।
আজেভেদো পরিবার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নাবিকদের আতিথেয়তায় সুনাম অর্জন করে ফেলতে সমর্থ হয়। তারা তাদের খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি সব ধরনের প্রয়োজন মেটানোরও দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে তারা পৃথকভাবে নজর কারে একটি উদ্যোগ দিয়ে। আর সেটি হলো, সেখানে কেও চাইলেই তার প্রিয়জনদের উদ্দেশ্যে বার্তাও রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তারা। চিঠিতে শুধু প্রাপকের নাম ও সাল উল্লেখ করতে হয়। পরবর্তীতে ওই রুটে সেই প্রিয়জন গেলে খোঁজ করে নিতে পারেন ওই চিঠি। স্মৃতিকাতর মানুষরা ক্যাফেতে বসে পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে আয়েশ করে পড়তে পারেন সেইসব চিঠি। উদ্যোগটি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ক্যাফেটিতে জমা রয়েছে অনেক পুরনো কিছু চিঠি। এখনও মানুষজন তাদের নামের চিঠি খোঁজ করে ফেরেন সেখানে।
ক্যাফেটির বর্তমানে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে উদ্যোক্তা এনরিক আজেভেদোর তৃতীয় প্রজন্ম। তারই নাতি হোসে এনরিক রেজিস্ট্রার খাতা খুলে দেখান বেশ পুরনো কিছু চিঠি। যারমধ্যে ১৯২৮ সালে লেখা চিঠিও রয়েছে।
সাগরের দুই হাজার মাইল ভেতরে ছোট্ট একটি দ্বীপে অবস্থিত ক্যাফেটিকে ২০০৪ সালে পর্তুগিজ ডাক পরিসেবা একটি গোল্ডেন পোস্ট অফিস সম্মানে ভূষিত করেছিলো। এছাড়াও ২০১৮ সালে পিটার ক্যাফে স্পোর্টের শততম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য একটি বিশেষ ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়েছিলো। যেখানে রয়েছে বর্তমান মালিক হোসে এনরিকের ছবি। আরেকটি ডাকটিকিটে রয়েছে ‘স্ক্রিমশো মিউজিয়াম’ এর ছবি। হোসের বাবা পিটার ১৯৮০ সালে এই জাদুঘরটি চালু করেছিলেন। মূলত এখানে প্রদর্শন করা হয় তিমির দাঁতের উপর আঁকা নানা ধরনের চিত্রকর্ম।
দ্বীপটিতে আসা নাবিকরা মূলত ৩টি কাজ করেন। প্রথমতো তারা হারবারের ডকের উপরে একটি চিত্র এঁকে রেখে যান, এটিকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়। তাছাড়াও তারা ‘পিটার ক্যাফে স্পোর্ট’ রেস্তোরাঁটির ঐতিহ্য অনুযায়ী নাবিকরা তাদের ইয়ট কিংবা ক্লাবের পতাকা এখানে রেখে যান। তৃতীয়ত তারা দর্শনার্থীদের জন্য রাখা ‘ইয়ট লক’ বইতে স্বাক্ষরও করেন, ধন্যবাদ জানান কিংবা নিজেদের অনুভূতিও প্রকাশ করেন।
চিঠি আদান প্রদান প্রকৃত পক্ষে কোনো অর্থের বিনিময় ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছে পিটার ক্যাফে স্পোর্ট। অর্থের চেয়ে মানুষের ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বই এই পরিবারের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন তারা।