দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ এক কালের সেই টরে-টক্কার টেলিগ্রাম এখন আর নেই। টেলিগ্রাম এখন শুধুই স্মৃতি। ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোনের এই রাজত্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ হয়ে উঠেছে খুবই সহজ একটি বিষয়। পোস্ট অফিসের চিঠি আর টেলিগ্রাম অফিসের জরুরি টেলিগ্রাম পরবর্তী প্রজন্মরা হয়তো চিনবেই না।
এখন আবার স্কাইপের মাধ্যমে দূর পরবাসে থেকেও মানুষ কথা বলছে স্বদেশে বসবাসরত প্রিয়জনের সঙ্গে। দেখতে পাচ্ছে একে অপরের জীবন্ত ছবি। কিন্তু একটা সময় এগুলো কল্পনা করাও ছিল কঠিন। ১৮৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বপ্রথম যন্ত্রের সাহায্যে পাঠানো হয় ছোট্ট একটা বার্তা। আধুনিককালের এসএমএস-এর আদি সংস্করণ বলা যেতে পারে একে। মাধ্যমটির নাম টেলিগ্রাম।
টেলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল যখন টেলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেন সারা পৃথিবীতে পড়ে যায় হৈ চৈ। এরপর প্রায় টানা ১৭০ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে বিশ্বজুড়ে খবর আদান-প্রদানে ব্যবহূত হয় এই মাধ্যম। কি আনন্দ, কি বেদনা সব সংবাদই মুহূর্তে পৌঁছে গেছে প্রাপকের কাছে। বহু সংবাদ টেলিগ্রাম নিজেই বয়ে নিয়ে গেছে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তার আগমনবার্তা এক সময়ের ধীরগতির নিস্তরঙ্গ জীবনে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভরিয়ে দিত শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায়। সেই টেলিগ্রাম এখন স্মৃতির জাদুঘরে।
১৪ জুলাই ভারত থেকে সর্বশেষ টেলিগ্রামটি পাঠানো হয়। এরপর টেলিগ্রাম চলে যায় জাদুঘরে। উপমহাদেশে টেলিগ্রামের গুরুত্ব বোঝা যায় বাংলা চলচ্চিত্রেও। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে মায়ের মৃত্যুর সংবাদ টেলিগ্রামের মারফতই পেয়েছিলেন কৃষ্ণেন্দুর ভূমিকায় অভিনয় করা উত্তম কুমার। ‘ফাদার অর মাদার ক্রিটিক্যাল, কাম শার্প’ ছবির একেবারে মোক্ষম মুহূর্তে এমন টেলিগ্রাম না আনতে পারলে চিত্রনাট্যের মোড় কীভাবে ঘোরাবেন, ভেবে কূল পেতেন না সিনেমার দক্ষ পরিচালকরাও। সিনেমাতে বহু সিরিয়াস, ট্র্যাজিক এবং কমিক দৃশ্যের অবতারণা করেছে একটিমাত্র টেলিগ্রাম। অথবা মহাগুরুত্বপূর্ণ টেলিগ্রাম যথাসময়ে না আসাটাই গল্পের শেষ পর্বে অসামান্য নাটকীয়তা এনে দিয়েছে। সেই মূল্যবান টেলিগ্রাম আজ নতমুখে বিদায় নিচ্ছে।
টেলিগ্রাম যুগ ভারতে শেষ হলেও বাংলাদেশে কিন্তু এখনই শেষ হচ্ছে না। ভারতের মতো বাংলাদেশে ঘোষণা দিয়ে টেলিগ্রামের যুগের বিলুপ্তি ঘটানোর কোন ইচ্ছেও নাকি নেই সরকারের। নামমাত্র চললেও বহু আবেগ মিশে আছে এই টেলিগ্রামের সঙ্গে। ঢাকা সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক আবুল হোসেন আলাপকালে বলেন, এক সময় আড়াই হাজারের মতো জনবল ছিল এই টেলিগ্রাফে। এখন আছে শ্থতিনেকের মতো। তাও কাজ করেন অন্য দফতরে। বাংলাদেশে প্রায় ৮শ টেলিগ্রাফ অফিস ছিল। আর এখন ৬৪ জেলার আছে ৪০টির মতো অফিস। তাও চলছে ধিক ধিক করে। কোথাও ঘরটি পরিত্যক্ত হয়েছে। আর কোন ঘরে জমেছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। তবে ওই ঘরগুলোতে এখন আর নেই টেলিগ্রাফের টরে টক্কা যন্ত্র। কোথাও আছে একটি ফ্যাক্স মেশিন, আবার কোথাও আছে একটি ল্যান্ড টেলিফোন।
আবুল হোসেন আরও বলছিলেন, টরে টক্কা যন্ত্রগুলো কেজির দরে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এখন আসলে কারা টেলিগ্রাম করেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, আবহাওয়া অধিদফতরই একমাত্র নিয়মিত গ্রাহক তাদের। এক-দেড় লাখ টাকা তাদের সেখান থেকে আয় হয়। সব জেলায় আবহাওয়া অফিস না থাকায় আবহাওয়া বার্তা পাঠানো হয় টেলিগ্রামের মাধ্যমে। এগুলো তারা টরে টক্কা যন্ত্র দিয়ে নয়, ফ্যাক্সের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। যেখানে ফ্যাক্স নেই সেখানে পাঠানো হয় ল্যান্ডফোনের মাধ্যমে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যদের ছুটির জন্য এখনো কোথাও কোথাও টেলিগ্রামের দরকার হয়। কোন সদস্য ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার পর বিপদ-আপদে ছুটি বাড়াতে শরণাপন্ন হন টেলিগ্রামের। কিছুদিন আগ পর্যন্তও বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন তথ্য আদান-প্রদান হতো টেলিগ্রামেই। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের শুরু থেকেই দাপটের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করেছে এই টেলিগ্রাম মাধ্যমটি। ১৯৮১ সালে সৌদি সরকারের অনুদানে টেলিগ্রাফ অফিস থেকে টাইপ রাইটার তুলে দিয়ে বসানো হয় টেলিপ্রিন্টার। তখন এক অফিসে বসে কোড ব্যবহার করে মোর্স কি দিয়ে লিখলে সংশ্লিষ্ট অফিসে কয়েক শব্দের একটা লেখা বের হত। যদিও তাতে অনেক সময় ভুল হলেও পরে তা ঠিক করার ব্যবস্থাও ছিল। এভাবেই চলছিল সবকিছু। ২০০৩ সালে সেই টেলিপ্রিন্টারকেও জাদুঘরে পাঠিয়ে বসানো হয় ফ্যাক্স মেশিন। এখন তার ব্যবহারও প্রায় শূন্যের কোঠায়।
এখনো বাংলাদেশে টেলিগ্রাম চালু থাকলেও এর মূল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) তাদের ওয়েবসাইটে টেলিগ্রামকে পাঠিয়ে দিয়েছে ‘জাদুঘরে’। টেলিগ্রামের বর্ণনা, এটি কী এবং এই সংক্রান্ত নানা তথ্য রাখা হয়েছে সংস্থাটির ওয়েবসাইটের ‘মিউজিয়াম’ লিংকে। সব অফিস থেকে এসব যন্ত্রপাতি কেজি দরে বিক্রি হলেও বিটিসিএলের উপ-পরিচালক (তার) মামলুকার রহমান ব্যক্তিগত আগ্রহে কিছু টরে টক্কা যন্ত্র সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, কখনো এর মিউজিয়াম হলে এই যন্ত্রগুলোর দরকার পড়বে। তখন টাকা হলেও এগুলো আর পাওয়া যাবে না। তাই অনেক কষ্ট করে বিটিসিএলের একটি কক্ষে এগুলো তিনি সংগ্রহ করে রেখেছেন। দরকার হলে তখন তিনি টরে টক্কা যন্ত্রগুলোকে জাদুঘরে দেবেন।
এক সময় মনে করা হয়, শুধু দুঃসংবাদই আসতো টেলিগ্রামে। আসলে শুধু দুঃসংবাদ নয়, অনেক সুসংবাদেরও বাহক ছিল টেলিগ্রাম ‘শুধু পিতামাতার অসুস্থতা বা প্রয়াণের খবর কেন, গেরস্তের ঘরে খোকা হওয়া, মেজ কুমারের বিলাত হতে ফেরা কিংবা ছোটখোকার সায়েবি আফিসে চাকরি হওয়ার সুসংবাদও উড়তে উড়তে নিয়ে গেছে টেলিগ্রাম বাড়ির সদর দরজায় হাসি হাসি মুখে অপেক্ষায় থেকেছেন বখশিস এবং মিষ্টান্ন প্রত্যাশী, গ্রামের বহু পুরাতন ডাকপিওনরা। দীর্ঘ এক সময় জুড়ে হাতেলেখা চিঠি এবং মাসকাবারি মানি অর্ডারের মতোই সামাজিক জীবনের শরিক থেকেছে টেলিগ্রাম কখনো যদি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই এসেছে সে সন্তান প্রসবকালে বড়খুকির মারা যাওয়া অথবা পুরনো মামলায় হার হয়ে বসতবাড়িটুকু বৈরী শরিকের হস্তগত হওয়ার দুঃসংবাদ এনেছে।’
বাঙালির জন্য টেলিগ্রামের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হয়েছে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। এই টেলিগ্রামের মাধ্যমেই বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর। আর্চার কে বাড তখন ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিক। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে তৎকালীন চলমান নৃশংসতা বন্ধে ব্যর্থ হওয়ায় কঠোর ভাষায় একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠানোর জন্য বিখ্যাত। তার সেই বিখ্যাত টেলিগ্রাম বার্তা ‘বাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত।
যখন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরু করে। ৬ এপ্রিল ১৯৭১ ঐতিহাসিক মার্কিন দূতাবাস থেকে একটি তারবার্তা পাঠানো হয়েছিল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে। ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কর্মকর্তারা ২৫ মার্চের ‘কলঙ্কিত রাতের’ গণহত্যা এবং সে বিষয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জারের অন্ধ ইয়াহিয়া ঘেঁষা নীতির প্রতিবাদ জানাতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন। তারা খুব ভেবেচিন্তে একটি তারবার্তা লিখেছিলেন যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন বাড ও তার ২০ জন সহকর্মী। তারা তাতে ঢাকায় ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত নীরবতার নিন্দা করেছিলেন। বাড তাতে কেবল স্বাক্ষরই দেননি, বাড়তি এক ব্যক্তিগত নোটও দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলো বাঙালিদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।’ হেনরি কিসিঞ্জার এই টেলিগ্রাম বা তারবার্তার জন্য আর্চার কেন্ট বাডকে নির্বাসন দণ্ডও দিয়েছিলেন।
এক সময় এদেশের সংবাদপত্রগুলোও এই টেলিগ্রামের নিউজে নির্ভর করতো। বিশেষ করে জরুরি নিউজগুলো মফস্বল শহর থেকে সংবাদদাতারা পাঠাতেন টেলিগ্রামের মাধ্যমে। আর তাই সে সময় সংবাদের শুরুতেই লেখা হতো ‘নিজস্ব সংবাদদাতার তার’। এমনিভাবে সংবাদপত্রসহ বহুবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এই টরে-টক্কার টেলিগ্রাম। টেলিগ্রাম অফিসে গেলে সেই টরে-টক্কার শব্দ শোনা যেতো। কিন্তু এখন আর সেই টরে-টক্কা নেই। নেই টেলিগ্রাম অফিসও। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় মোবাইল-ইন্টারনেটে নিমিষেই সব বার্তা পেয়ে যান। তবুও আমাদের হৃদয়ে এখনও রয়েছে সেই টরে-টক্কার শব্দ। আমাদের হৃদয়ে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা যেনো বাড়ি খেতে থাকে ঠক..ঠক..করে… এ বাড়ি হয়তো থামবে, যখন হৃদয় স্পন্দন থাকবে না। তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক।
This post was last modified on সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৩ 4:22 অপরাহ্ন
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ড এবং লেবাননজুড়ে ভয়াবহ হামলা চলমান রেখেছে…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ স্বপ্ন দেখে তা মনে রাখা সত্যিই দুষ্কর। আর তাই রাতের…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শুভ সকাল। শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪ খৃস্টাব্দ, ৩০ কার্তিক ১৪৩১…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ অনেকই সুজি খেতে খুবই ভালোবাসেন। তাই তারা প্রতিদিন সুজির পায়েস,…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ প্রথমবারের মতো প্যান ইন্ডিয়ান চলচ্চিত্র বানিয়েছেন নির্মাতা অনন্য মামুন। ঢালিউড…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আপনার যদি প্রতিদিন চিকেন খাওয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে জেনে রাখুন,…