দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ টেস্ট ক্রিকেটে অসাধারণ এক রেকর্ডের একমাত্র মালিক বনে গেছে সোহাগ গাজী। ব্যাপারটির গভীরতা যে আসলে কতোখানি সেটা বুঝতে পুরো ক্রিকেট বিশ্বেরই কিছুটা সময় লেগেছে। ১৩৬ বছরের টেস্ট ইতিহাসে শত রথী মহারথীর ভীড়ে প্রথমবারের মতো একই ম্যাচে সেঞ্চুরি + হ্যাট্রিক + পাঁচ উইকেট নেয়ার ঘটনা যে এটাই প্রথম!
মজার ব্যাপারটি হলো, এক সপ্তাহ আগে এই ঘটনাটি ঘটলেও এটি নিয়ে সোহাগ গাজীর কোনো শিশুসুলভ আনন্দও নেই! পুরোপুরি পেশাদার ক্রিকেটারের মতো তিনি এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছেন এবং সামনের দিনগুলোতে কীভাবে নিজের পারফরম্যান্সকে আরও উপরে তোলা যায় সেই ছক কষছেন।
সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে গাজীর একান্তই নিজস্ব কিছু অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা যার ফলেই আজকে তিনি এরকম পেশাদার আচরণ করতে পারেন! গাজী বলেন, “আমার কিশোর বয়সে আমি সংগ্রাম করে বড় হয়েছি, আমার পাশে এসে দাঁড়ানোর কেউ ছিলো না। তবে আমার আগ্রহ এবং খেলাটার প্রতি একাগ্রতা দেখে বয়স ভিত্তিক খেলায় আমাকে কেউ একজন সুযোগ দিয়েছিলো, এছাড়া আমার পুরো বংশের কেউ কোনোদিন ক্রিকেট খেলেনি। আমি সবসময়ই মনে করতাম আমি একা, আমাকে একাই লড়াই চালাতে হবে, সুতরাং একা লড়াই চালাতে হলে আলাদা অন্যরকম কিছু করে দেখাতেই হবে!”
“অফস্পিনার ক্রিকেটারের কোনো ভবিষ্যৎ নেই একথাটা আমাকে প্রায়ই শুনতে হতো, এবং অফস্পিন বোলিং করে আসলে দলের উপকারে আসা যায়না এমনটিও শুনতে হয়েছে আমাকে। কাজেই প্রতিক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করাটা ছিলো আমার জন্য আবশ্যক। আজকের এই জাতীয় দলে এসে খেলার পেছনে যে অফস্পিন বোলিং নিয়ে যে পরিশ্রম আমি করেছি সেটা নিয়ে এখন গর্বই হয় আমার!”
সোহাগ গাজী তাঁর প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটের অভিষেক দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “তীব্র আকাংখা থেকেই প্রথম ম্যাচেই পাঁচ উইকেট পেয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছি, নইলে হয়তো পরের ম্যাচেই বাদ পরে যেতাম! আমি যেখান থেকে খেলাতা শিখে এসেছি সেখান থেকে হঠাৎ করেই প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলতে সুযোগ করে দেয়াটা আমার জন্য সৌভাগ্য ছিলো বলেই মনে করি। বরিশাল বিভাগের তৎকালীন কোচ এহসান স্যারের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ কারণ তিনি আমার উপর আস্থা রেখে আমার হাতে বল তুলে দিতে বলেছিলেন।”
জাতীয় লীগে পরপর দুইটি ভালো মৌসুম কাটিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার পরই গাজী জাতীয় ক্রিকেট একাডেমীতে সুযোগ পেয়ে যান। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম শ্রেণীর চারদিনের ম্যাচে তিনি তুলে নেন ১১টি উইকেট, ছিলো হ্যাটট্রিক। মূলত তখনই গাজী ক্রিকেট বিশ্বে মোটামুটি আলোচনায় চলে আসেন।
এর চারমাস পরেই খুলনা বিভাগের বিপক্ষে ৯৯ বলে ১৪০ রানের ঝড়ো ইনিংসের সাথে গাজী তুলে নেন হ্যাটট্রিক উইকেট, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যে কৃতিত্বের মালিকও গাজী একাই। সেই সেঞ্চুরি সম্পরকে গাজী বলেন, “আমি যখন ৫০ রান করে ফেলি তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই যে একবার সুযোগ নেয়াই যাক! দেখি সেঞ্চুরিটা হয় কীনা, এবং আমি সেঞ্চুরির দেখা পেলাম!”
“সেই ম্যাচের হ্যাটট্রিকের কথা আমি কখনোই ভুলবো না কারণ তারপরই আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় দলের দরজা আমার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়!”
মাত্র এক বছর আগেই প্রথম টেস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গাজী জানান, “আগের রাতে মুশফিক ভাই এসে আমাকে জানান সম্ভবত আমি ওপেনিং বোলিং করবো! প্রতিপক্ষ ক্রিস গেইল! কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম সেটারই ফল তুলে গেইল সেই ওভারে আমার কাছ থেকে ১৮ রান নিয়ে নিয়েছিলো, কিন্তু তৃতীয় ওভারে আর গেইলকে সে সুযোগ দেইনি আমি, এবং সেই সিরিজে পুরোটা সময়ই গেইলকে আমার বোলিংয়ে পরাস্ত হতে হয়েছে! এটা আমি খুব উপভোগ করেছি!” গাজী হয়তো ভুলে গেছেন সেই ম্যাচে গাজী ৯ উইকেটও দখল করেছিলেন!
এ কথা অনস্বীকার্য যে চট্টগ্রাম টেস্টে গাজীর শতকটি না হলে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যেতে পারতো বাংলাদেশ। গাজী বলেন, “ব্যাট করতে যাওয়ার আগে আমার লক্ষ্য একটাই ছিলো ক্রিজে যতোটা পারা যায় নাসির ভাইকে সঙ্গ দিয়ে খেলা। প্রথম বলটি আমি ব্যাটের মাঝখানে লাগাতে পেরেছিলাম, ওতেই আমার আত্মবিশ্বাস চলে আসে। আমি সিদ্ধান্ত নিই যে সোজা খেলবো এবং মারার বল বাদে বাকীসবগুলো বলই ভুলে যাবো। এটাই কাজে দিয়েছে, আমি সেঞ্চুরির করে বসেছি! আর তারপর হ্যাটট্রিক নিয়েতো সবার মাতামাতি দেখে ভালো লেগেছে যে দলের জন্য কিছু হলেও অবদান রাখতে পেরেছি!”
নিজের ক্রিকেট দর্শন এবং ইচ্ছা নিয়ে গাজী ব্যক্ত করেন মনের কথা, “আমি ন’বছরের চেষ্টায় এখানে এসেছি। আমি দেখতে চাই এর শেষ কোথায়! বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করা আমার অন্যতম স্বপ্নগুলোর একটি!”
তথ্যসূত্রঃ ক্রিকইনফো