টাঙ্গাইলের অন্যতম শিল্প হচ্ছে তাঁত শিল্প। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। কিন্তু ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসনে এই শিল্প আজ এক অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি নিয়ে এই প্রতিবেদনটি টাঙ্গাইল থেকে পাঠিয়েছেন সোহান আহমেদ।
মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুদের পূজা এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সব রকম উৎসব আয়োজনে, উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও আমলাদের স্ত্রী-কন্যাদের চাহিদা ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে টাঙ্গাইলের তৈরি তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইলের অন্যতম শিল্প হচ্ছে তাঁত শিল্প। এ তাঁত শিল্পে তৈরিকৃত শাড়িই টাঙ্গাইলের সুনাম বা পরিচিতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী। এটি বাঙালী জাতির হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য।
ভ্রমণ পিপাসু বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এদেশে এসেছিলেন তার লেখায় টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের বিধৃত রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকা জয় করেছে টাঙ্গাইলের তাঁত বস্ত্র। টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প আজ যে বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছে তা একদিনে আসেনি। বসাকদের অপরিসীম ত্যাগ, নিষ্ঠা ও নিরলস পরিশ্রমের ফলেই টাঙ্গাইলের এককালের সাধারণ মানের তাঁতের শাড়ি আজ বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসাক সমপ্রদায়ের তাঁতীরাই টাঙ্গাইলের আদি তাঁতী। এদেরকে এক শ্রেণীর যাযাবরও বলা যায়। সিন্ধু সভ্যতার অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। সেখানকার আবহাওয়ায় শাড়ির মান ভাল না হওয়ায় নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয় বসাকরা। চলে আসে বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। সেখানকার আবহাওয়া তেমন ভাল না থাকায় বসাকরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। এদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সাথে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যান।
ধামরাইয়ে শাড়ির মান তেমন একটা ভাল না হওয়ায় আরও ভাল জায়গা খোঁজ করতে করতে টাঙ্গাইলে এসে বসতি স্থাপন করে। টাঙ্গাইলের আবহাওয়া তাঁতের শাড়ি বুননের উপযুক্ত হওয়ায় পুরোদমে তাঁতের কাজ শুরু করেন বসাকরা। এক সময় টাঙ্গাইলের বেশিরভাগ এলাকাজুড়েই ছিল বসাকদের বসবাস। তারা অনভিজ্ঞদের বসাক সমিতির মাধ্যমে কাপড় বুননের প্রশিক্ষণ দিতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বসাক তাঁতীরা ভরতে চলে যায়। ওই সময় বসাক ছাড়াও অন্যান্য সমপ্রদায়ের লোকেরাও তাঁত শিল্পের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পরে। তারাও বসাক তাঁতীদের মত দক্ষ হয়ে উঠেন। বর্তমানে টাঙ্গাইলের সর্বাধিক তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা- টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, তারুটিয়া, বেলতা, গরাসিন। কালিহাতী উপজেলার বলস্না, রামপুর, মমিননগর, সিংগাইর, ছাতিহাটি, কামান্না, টেঙ্গুরিয়া, নাগবাড়ি, ঘোনাবড়ি, জোড়বাড়ি, তেজপুর, গান্ধিনা, বড়টিয়াবাড়ি, বাংড়া, সহদেবপুর, কাজিবাড়ি, দড়িখশিলা, কদিম খশিলা, কুকরাইল। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, নলসন্ধা প্রভৃতি গ্রামে টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি হয়।
এসব এলাকায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শোনা যায় মাকুর খট-খট শব্দ। দেখা যায় তাঁত শিল্পীদের নিপুন হাতে শাড়ি বুনার দৃশ্য। টাঙ্গাইলের লক্ষাধিক তাঁতের সাথে জড়িত আছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা। টাঙ্গাইল শাড়ি বুনে পুরুষরা, চরকায় সূতা কেটে সহায়তা করে মহিলারা। টাঙ্গাইল শাড়ি বুনার তাঁত কয়েকরকমের রয়েছে তারমধ্যে চিত্তরঞ্জন (মিহি), পিটলুম (খট-খটি), অটোমেটিক, সেমি অটোমেটিক তাঁত উল্লেখযোগ্য। এসব তাঁতে তৈরি হয় নানা রঙ ও ডিজাইনের নানা নামের শাড়ি। কথা হয় বল্লা গ্রামে অবস্থিত সোহান উইভিং ফ্যাক্টরী’র মালিক মোঃ আমিনুর ইসলামের সাথে।
তিনি জানান বল্লা ও আশেপাশের বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে তৈরি হয়, জামদানি, বালুচুরি, সফ্ট সিল্ক, হাফ্ সিল্ক, হাজারবুটি, থান, বেনারশী, সুতি পাড়, কটকি, স্বর্ণচুর, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, প্রভৃতি ও সাধারণ নামের শাড়ি। তিনি আরও জানান, শাড়ির বিভিন্ন নাম ও মানের কারণে বিভিন্ন রকম দাম হয়ে থাকে। সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকার উপরে পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর মধ্যে জামদানির দাম সবচেয়ে বেশি। জামদানি তৈরি হয় আন্তর্জাতিক মানের। এ শাড়ি তৈরির জন্য ৮২ কাউন্টের সূতা ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য শাড়ি তৈরিতেও ৮২ কাউন্টের সূতা ব্যবহার করা হয়। নারায়নগঞ্জে প্রস্তুতকৃত ৬০, ৬২, ৭৪, ৮২, ৮৪ কাউন্টের সূতাও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
দেশ ভাগের পূর্বে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির হাট বসত কলকাতায়। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতীরা চারাবাড়ি ঘাট হয়ে স্টীমার, লঞ্চ ও জাহাজে চড়ে কলকাতায় যেতেন। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির প্রধান হাট টাঙ্গাইলের বাজিতপুর, করটিয়া, কালিহাতীর বল্লা বসত। এসব হাটে বেশিরভাগ ক্রেতাই মহাজন শ্রেণীর। মহাজনরা ওইসব হাট থেকে পাইকারী দরে শাড়ি কিনে সারা দেশের বড়বড় মার্কেট ও শপিংমলে বিক্রি করে থাকেন। মহাজনদের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও আমলাদের স্ত্রী ও কন্যারাও ওইসব হাট থেকে তাদের পছন্দের শাড়ি কিনে নিয়ে যায়। দেশের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ জাপান, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির কদর থাকলেও কাঁচামাল সরবরাহ সহজলভ্য না থাকায়, কাঁচামালসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
ভারতীয় শাড়ির অগ্রাসন
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির চেয়ে ভারতের শাড়ির দাম কম থাকায় অনেক ক্রেতা সে দিকে ঝুঁকে পড়ায়, মহাজনী চক্রের হাতে বন্দি হয়ে পড়ার ফলে বিপনন ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে না হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে টাঙ্গাইল শাড়ি মার খেয়ে যাচ্ছে। এত প্রতিকূলতার মাঝেও টাঙ্গাইল শাড়ি তার বাজার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কারণ টাঙ্গাইল শাড়ি মানেই বিভিন্ন সূতায় আলাদা তাঁতে তৈরি আলাদা বৈশিষ্ট্যের শাড়ি। এর নকশা, বুনন এমনকি রঙ এর মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র। এছাড়াও সময় চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ির আকর্ষণ ও নকশার কর কৌশল। এছাড়াও টাঙ্গাইলের তাঁতীরা গামছা, লুঙ্গি ও চাদর তৈরি করে থাকে। এত কিছুর পরও আজ যান্ত্রিক শিল্পের প্রতিযোগীতায় তাঁত শিল্প হুমকির মুখে। প্রায় লড়্গধিক তাঁতী কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছে এই তাঁত শিল্পকে মানবেতর এসব শ্রমজীবি তাঁতীদের টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন। সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা।
# ধন্যবাদান্তে: সোহান আহমেদ, বল্লা, কালিহাতী, টাঙ্গাইল।