ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সমস্যার আপাতত সমাধানের পথে এগিয়েছে। অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন রাজা পারভেজ আশরাফ।
২২ জুন রাতে মজলিস-ই-শূরার অধিবেশনে ২১১ ভোট পেয়ে সৈয়দ ইউসুফ রাজা গিলানির উত্তরসূরি নির্বাচিত হন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) এ জ্যেষ্ঠ নেতা। তার প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রার্থী (নওয়াজ) মেহতাব আফতাব খান আব্বাসী পান ৮৯ ভোট। ১৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিসহ পিপিপি ও শরিক দলের নেতারা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও জাঁদরেল নেতাদের অভিনন্দনেও সিক্ত হয়েছেন তিনি। তারপরও পাকিস্তানের সংকট শিগগিরই কাটছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
উল্লেখ্য, এর আগে সকালে সংবাদ সম্মেলনে পিপিপির আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা এবং শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী সৈয়দ খুরশিদ শাহ ক্ষমতাসীন জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সাবেক বিদ্যুৎ ও পানিমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় দুই শরিক দল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) হায়দার আব্বাস রিজভী এবং আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) আফরাসিয়াব খাতক সঙ্গে ছিলেন। ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, বিবিসি, পাকিস্তান অবজারভার, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানায়।
সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, আদালত ২১ জুন মাখদুম শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করার পর দেশটির প্রেসিডেন্ট ও পিপিপির কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারি জোটের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে রাজা পারভেজ আশরাফকে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। কিন্তু তারপরও এতটা নির্বিঘ্ন থাকেনি পারভেজ আশরাফের পথচলা। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তখনও লড়াইয়ের ময়দানে ছিলেন তিন প্রার্থী। পিপিপিরই আরেক নেতা কমর জামান কয়রা, জমিয়ত-ই-উলামায়ে ইসলামের (এফ) প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান এবং প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের (নওয়াজ) মেহতাব আফতাব খান আব্বাসী। এর মধ্যে কমর জামান কয়রা পারভেজ আশরাফকে সমর্থন জানালেও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান জমিয়ত-ই-উলামায়ে ইসলাম নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান। ২২ জুন দুপুরে ক্ষমতাসীন পিপিপি জোটের তিন জ্যেষ্ঠ নেতা কমর জামান কয়রা, খুরশিদ শাহ ও চৌধুরী সুজাত হুসাইন তার সঙ্গে দেখা করে পারভেজ আশরাফের সমর্থনে তার (ফজলুর রহমান) মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। কিন্তু আশরাফের চেয়ে তিনি ভালো প্রার্থী- এমন দাবি করে জোট নেতাদের ফিরিয়ে দেন তিনি।
এরপর নওয়াজ শরিফের দল মুসলিম লীগের নেতারাও যান মাওলানা ফজলুর রহমানের কাছে। তারা মেহতাব আফতাব খান আব্বাসীর সমর্থনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন জানান। তাদেরও বিরস বদনে ফেরান তিনি। তবে সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ামাত্র কাওকে সমর্থন না করেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন তিনি। এমনকি সংসদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা থেকেও বিরত থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাই লড়াইটা দু’জনে গিয়ে ঠেকে।
রাওয়ালপিণ্ডির পিপিপি নেতা পারভেজ আশরাফের বিরুদ্ধেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতির বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ভাড়াভিত্তিক ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর ওই মামলা হওয়ার পর গত বছর তিনি মন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন।
রাজা পারভেজ আশরাফ সিন্ধু প্রদেশের সাংহারে ১৯৫০ সালের ২৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। গিলানির মন্ত্রিসভায় তিনি মার্চ ২০০৮ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১১ পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও পানিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে ন্যাশনাল এসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে তিনি ক্ষমতাসীন জোটের মন্ত্রিসভায় স্থান পান। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হিসাব মতে, তার সম্পত্তির পরিমাণ ৬ কোটি ২০ লাখ রুপি।
উল্লেখ্য, সুপ্রিমকোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রী ও মজলিস-ই-শূরা সদস্য পদে সৈয়দ ইউসুফ রাজা গিলানিকে ১৯ জুন অযোগ্য ঘোষণা করা হলে অর্থনৈতিক সংকট, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও জঙ্গিবাদ নিয়ে হাবুডুবু খাওয়া পাকিস্তান আরও গভীর সংকটে পড়ে। সমস্যার সমাধানে গিলানিকে অপসারণ করে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পথে হাঁটাকেই শ্রেয়তর মনে করে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট। গিলানির উত্তরসূরি হিসেবে পিপিপির প্রথম পছন্দ ছিলেন পিপিপির জ্যেষ্ঠ নেতা, বিদ্যুৎ ও পানিমন্ত্রী মাখদুম শাহাবুদ্দিন। পিপিপি নেতৃত্বাধীন জোটও তাকেই মনোনয়ন দেয়। ২১ জুন দুপুরে তার মনোনয়নপত্র দাখিল করার কথাও ছিল। কিন্তু তার আগে সকালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে অবৈধ মাদক আমদানির অভিযোগে রাওয়ালপিণ্ডির মাদকবিরোধী আদালত তার বিরুদ্ধে ওই পরোয়ানা জারি করেন। ফলে আবারও পাল্টে যায় সমীকরণ। পরে জারদারি রাজা পারভেজ আশরাফকে পিপিপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন। এর পরপরই ২২ জুন পেশোয়ার হাইকোর্টে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান মাখদুম শাহাবুদ্দিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মাঝ থেকে প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বাদ পাওয়া ভাগ্যে জুটল না তার! বিশ্লেষকদের মতে, যেহেতু পারভেজ আশরাফের বিরুদ্ধেও মামলা ঝুলছে, সেক্ষেত্রে তার পরিণতি কী হবে তা দেখার বিষয়।
আরও দেখার বিষয়, দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অর্থপাচারের মামলা পুনরায় চালু করতে সুইজারল্যান্ডের সরকারকে চিঠি লিখতে প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দেশটির সুপ্রিমকোর্ট। কিন্তু গিলানি সেই নির্দেশ পালন না করায় ২৬ এপ্রিল তাকে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যার পরিণতি গিলানির অপসারণ। এখন দায়িত্ব নেয়ার পর আদালতের নির্দেশনা অনুসারে পারভেজ আশরাফও কি জারদারির বিষয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে চিঠি লিখবেন। এক্ষেত্রে তিনি যদি গিলানির পথ অনুসরণ করেন, তাহলে তার ব্যাপারে আদালতের ভূমিকা কী হবে? যদি তিনি জারদারির বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবিত না করেন, আদালত কি নতুন প্রধানমন্ত্রীকেও অযোগ্য ঘোষণা করবেন! এ প্রশ্ন এখন সকলের মনেই দানা বেধে উঠেছে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ওপর। ভবিতব্যই বলে দেবে পাকিস্তানে কি হবে।