Categories: বিনোদন

সুচিত্রা সেন শুরু এবং শেষ: কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন যেভাবে

দি ঢাকা টাইমস্‌ ডেস্ক ॥ গতকালই দাহ করার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটেছে কিংবদন্তি অভিনেত্রী মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে গবেষণার যেনো শেষ নেই। তিনি একাধানে ৩৫ বছর সমাজ-সভ্যতা থেকে সরে ছিলেন। তারপরও তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি। কিভাবে তাঁর এই উত্থান তার বিশ্লেষণ এ রিপোর্টে।

সুচিত্রা সেনের চলে যাওয়ার ঘটনা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি কেনো দীর্ঘ ৩৫টি বছর অপ্রকাশ্য থেকে জীবন-যাপন করলেন সেটি বড়ই সহস্যাবৃত। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে বিজ্ঞরা গবেষণা করছেন। তবে সচরাচর এমনটি দেখা যায় না। তিনি স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাই বলে তার সেই জুটি উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা থাকলেও কখনও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবেননি।

ইতিহাস যা বলে

কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন হওয়ার কাহিনীটি বেশ চমকপ্রদ। সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালের ৬ই এপ্রিল পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আট ভাইবোনের মধ্যে মেজো। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বাবার বড় আহ্লাদি ছিলেন সুচিত্রা সেন। ছোটবেলায় লেখাপড়াও পাবনাতেই। পাটনায় মামার বাড়িতেও কিছুদিন থেকেছেন। সেখানেই এক নাগা সন্ন্যাসী তিন বছরের ছোট্ট রমাকে দেখে বলেছিল, মেয়েটি সুলক্ষ্মণা। বড় হলে ওর নামডাক হবে। কথাটা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছিল। দেশভাগের সময় সুচিত্রা সেন চলে গিয়েছিল ভারতে। তবে বাবা করুণাময় অবসরের পরই পাবনা ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে যান ভারতে। উঠেছিলেন শান্তিনিকেতনের পাশে ভুবনডাঙ্গায়।

অসামান্য সুন্দরী হওয়ার কারণে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পপতি প্রিয়নাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অনেকটা জেদের বশেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। নিত্যনতুন অশান্তির কালো মেঘ সরাতে অবশ্য সময় নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবি যখন করছেন তখনই ডিভোর্স হয়ে যায় সুচিত্রা সেনের। এই ছবিটি ছিল তার জীবনের সেই সময়েরই প্রতিচ্ছবি। ছবিতে একটি দৃশ্যে সুচিত্রা রাগে সৌমিত্রের জামা ছিড়ে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি শুটিংয়ের দিনে তার বাড়িতেই হয়েছিল। কথা কাটাকাটির জেরে স্বামীর জামা ছিঁড়ে চলে এসেছিলেন সোজা শুটিংয়ে। সুচিত্রার সিনেমায় নামা কিন্তু তার নিজের ইচ্ছায় নয়। স্বামী দিবানাথই জোর করেছিলেন সুচিত্রা যাতে অভিনয় করে। শোনা যায়, সিনেমার জন্য প্রথম টেস্ট দিতে গিয়ে ডাহা ফেল করেছিলেন সবার মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। অবশ্য তখনও তিনি রমা সেন। ততদিনে জেদ চেপে বসেছে। অভিনেত্রী হবেনই। পরে অবশ্য স্ক্রিনটেস্টে উতরে গিয়েছিলেন। শুরু হয় তার চলচ্চিত্রে অভিনয় জীবন।

১৯৫২ সালে সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’। কিন্তু সেই ছবি মুক্তি পায় নি। মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি ১৯৫৩ সালের ‘সাত নম্বর কয়েদি’। এই ছবিতেই রমা সেন পরিবর্তিত হয়েছিলেন সুচিত্রা সেন নামে। ছবির পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারী নীতিশ রায়ই এই নতুন নামটি দিয়েছিলেন। তবে প্রথম উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ই ব্রেক এনে দিয়েছিল। তারপর থেকে সুচিত্রা সেন নিজের জেদ ও অধ্যবসায়ে বাঙালির হৃদয়ের রাণীতে পরিণত হয়েছিলেন।

Related Post

১৯৫৩ সালেই ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে। আর এই ছবিটিই তার জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল। সুচিত্রা তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘ভগবান শ্রীষ্ণৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবি আমার জীবন পাল্টে দেয়। আমি বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তারপর থেকেই আমি নির্ভয়, ভেতর থেকে কে যেন আমাকে চালায়।

১৯৫৩-১৯৭৮ সালের মধ্যে একের পর এক সাড়া জাগানো ছবি করেছেন। তার ম্যানারিজমকে পর্যন্ত বাঙালি আপন করে নিয়েছিল। ওরা থাকে ওধারে, অগ্নিপরীক্ষা, উত্তর ফালগুনী, শাপমোচন, শিল্পী, দীপ জ্বেলে যাই, হারানো সুর, সাতপাকে বাঁধা, অগ্নিপরীক্ষা, সূর্যতোরণ, সাগরিকা, সপ্তপদী এমনি অসংখ্য ছবিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় তার সময়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল, মানুষের হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল। সেজন্যই তিনি সহজেই কিংবদন্তি নায়িকায় পরিণত হয়েছিলেন। উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী- সবার বিপরীতে আভিনয় করলেও উত্তম কুমারের সঙ্গে যে ৩০টি ছবি করেছেন তাতে সুচিত্রা-উত্তম জুটির রোমান্স এতটাই স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল যে, কখনোই তাদের অভিনয় দেখে- অভিনয় বলে মনে হয় নি কারো কাছেই। আর দু’জনের এই রসায়নের কারণেই মেয়ে মুনমুন সেন পর্যন্ত একবার মাকে বলেছিলেন, মা তোমার উত্তম কুমারকে বিয়ে করা উচিত ছিল। শুনে সুচিত্রা সেন নাকি শুধু হেসেছিলেন। আসলে সুচিত্রা-উত্তমের মধ্যে যে প্রবল আন্ডারস্ট্যান্ডিং চলচ্চিত্রে রূপ পেয়েছে তা আগে কখনো অন্তত সিনেমা ইতিহাসে হয়নি। আর তাই সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত বলেছেন, পৃথিবীতে খুব কম জুড়ি আছে যাদের মধ্যে বন্ডটা এতো ম্যাজিকাল। তবে অত্যন্ত সফিস্টিকেটেড সুচিত্রা সেন খুবই জেদি ছিলেন। যখন যেটা করবেন বলে ঠিক করেছেন তখন সেটাই করেছেন বলে শোনা যায়। তিনি প্রযোজকদের উত্তম কুমারের উপরে তার নাম লিখতে বাধ্য করেছিলেন। সবাই সেটা মেনেও নিয়েছিল। আর তাই উত্তম-সুচিত্রা জুটি না হয়ে আসলে হয়েছিল সুচিত্রা-উত্তম জুটি।

সুচিত্রা বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। ১৯৫৫ সালে দেবদাস করেছেন। দেবানন্দকে নিয়ে করেছেন ‘বোম্বাই কা বাবু’ ও ‘সরহদ’। আর গুলজারের পরিচালনায় ‘আঁধি’ ছবিতে ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রে তার অভিনয় সবাইকে চরম মুগ্ধ করেছিল। তাকে এক মুহূর্তের জন্য আনডিগনিফায়েড হতে দেখা যায় নি। আর তাই সত্যজিৎ রায়কে, রাজ কাপুরকে পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সেই কাহিনীতে জানা যায়, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ছবি করতে রাজি ছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু শর্ত দিয়েছিলেন সত্যজিৎ তার সঙ্গে যতদিন কাজ করবেন ততদিন অন্য ছবিতে কাজ করা চলবে না। সুচিত্রা এর উত্তরে বলেছিলেন, সেটা কি করে হয় যারা তাকে সুচিত্রা সেন বানিয়েছেন তাদের তো বাদ দেয়া চলবে না। তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ বাবুর জন্য বেশি সময় দেবেন। কিন্তু পরদিন প্রযোজক যখন চুক্তিপত্রের খসড়া নিয়ে এলেন তাতে এক্লুসিভ আর্টিস্ট কথাটি লেখা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সেটি ছুড়ে ফেলে দেন সুচিত্রা। সরাসরি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রযোজককে।

অন্যদিকে রাজকাপুরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পেছনে ছিল অন্য এক গল্প। রাজকাপুর নাকি সুচিত্রাকে প্রেম নিবেদন পর্যন্ত এগিয়েছিলেন। একদিন বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে এসেছিলেন রাজকাপুর সিনেমার প্রস্তাব নিয়ে। সাদা সুট, সাদা নেকটাই আর হাতে একরাশ লাল গোলাপ নিয়ে সুচিত্রার পায়ের কাছে বসে তার প্রযোজিত কোন ছবিতে কাজ করার জন্য বলেছিলেন। সুচিত্রা তখনই তাকে না বলে দিয়েছিলেন। সুচিত্রার এই না করা নিয়ে ঘনিষ্ঠদের কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল। ও পুরুষ মানুষ নাকি, মেয়েদের পায়ের কাছে বসে, দূ-র। আর তাই না বলে দিতে কোন দ্বিধা করিনি।’

তবে নিজের সম্পর্কে অসম্ভব সচেতন ছিলেন সুচিত্রা। আর তাই ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিটি দর্শক ভালভাবে না নেয়ায় সুচিত্রা সেন সিনেমাকে বাই বাই জানাতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি। তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল পাবলিকের প্রত্যাশা আর পূরণ করতে পারবেন না তিনি। আর সেই থেকেই তিনি চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তবে শোনা যায়, তার ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ নিয়ে কোন ছবি হলে তাতে দামিনী চরিত্রে অভিনয় করবেন। একবার কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রযোজক হঠাৎ আত্মহত্যা করায় আর সেই ছবি করা হয় নি তাঁর। এই একটি ব্যাপারে তার আপসোস জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও নাকি ছিল।

১৯৭৮ সালে ২৫ বছরের অভিনেত্রী জীবনে ইতি টেনে সেই যে তিনি অন্তঃপুরবাসিনী হয়েছেন, তারপর তিনি খুব একটা লোকসমক্ষে আসেননি কখনও। আর বাইরে যে বের হতেন না তা নয়। শপিং করতে যেতেন। কিন্তু পড়তে হতো নানা বিড়ম্বনায়। একবার তো বিশাল কালো চশমায় মুখ ঢেকে বইমেলায়ও গিয়েছিলেন ১৯৮৪ সালে। কিন্তু জানাজানি হওয়ার পর পালিয়ে বাচেন তিনি। অবশ্য উত্তম কুমারের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে রাতের অন্ধকারকেই বেছে নিয়েছিলেন। ফুলের মালা দিয়ে উত্তম কুমারের খুব নিকটে বেশ কিছু সময় ছিলেন এই মহানায়িকা।

তবে যত কাহিনী থাকুন মহানায়িকার জীবন ইতিহাস এক অন্যরকম ইতিহাস। তিনি সব সময়ই ছিলেন সবার থেকে এক ব্যতিক্রমি নায়িকা। আর তাই তিনি চলে যাওয়ার পরও তাঁকে নিয়ে হচ্ছে নানা গবেষণা। তাঁর নীতি ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া আজ-কালকার নায়িকাদের জন্য অতি জরুরি। তিনি কখনও কারো কাছে মাথা নত করেননি এমনকি নিজের প্রেম-ভালবাসাকেও তিনি রেখেছেন সব কিছুর ঊর্দ্ধে। যার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন এই জগত সংসারে।

This post was last modified on জানুয়ারী ১৮, ২০১৪ 3:07 অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার

Recent Posts

মার্কিন নির্বাচন: জরিপে এগিয়ে আছেন কমলা

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকী আর মাত্র দুই সপ্তাহ। এই…

% দিন আগে

ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ সম্পর্কে সর্বশেষ যে বার্তা দিয়েছে আবহাওয়া অফিস

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি কক্সবাজার সমুদ্র বন্দর হতে ৬৫০ কিমি…

% দিন আগে

কফির মধ্যে আরশোলা! অভিযোগ জানিয়েও তরুণীর প্রাপ্তি শুধু একটা ‘সরি’!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ভারতের দিল্লির খান মার্কেট এলাকার একটি ক্যাফে থেকে আইস‌্‌ড লাতে…

% দিন আগে

গ্রামের শিশু-কিশোরীরাও নৌকা চালাতে পারদর্শী

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শুভ সকাল। বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪ খৃস্টাব্দ, ৭ কার্তিক ১৪৩১…

% দিন আগে

পেটের সমস্যায় নিত্যদিন ভোগেন আপনার সন্তান: তার ডায়েটে কী রাখলে মুক্তি আসবে?

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আপনার সন্তান নিয়মিত গ্যাস ও অ্যাসিডিটিতে ভুগলে তার ডায়েটে জুড়ে…

% দিন আগে

বাংলাদেশের বাজারে রয়্যাল এনফিল্ড

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ অবশেষে অনুমোদনের দীর্ঘ এক বছর পর বাংলাদেশের বাজারে এলো ‘রয়্যাল…

% দিন আগে