যোবায়ের আল মাহমুদ ॥ সাম্প্রতিক সময়ে জীবনরক্ষাকারী নানা ওষুধের অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধিতে ওষুধের বাজারে যেমন অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তেমনি ক্রেতা সাধারণের স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগীদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে অনেক ওষুধ।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ভাষ্য মতে, গত ছয় মাসে এক হাজার ২০০টির বেশি ওষুধের দাম ২০ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়েছে। উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, হূদরোগ, কিডনির রোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিসসহ প্রায় সব রোগের ওষুধের দাম সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। অনেক এন্টিবায়োটিক ওষুধের দাম দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ওষুধের দামবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর মালিক পক্ষ দামবৃদ্ধির জন্য উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমেছে। একই পরিমাণ কাঁচামাল আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। এতে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
ওষুধের এ অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন করছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ডলার আর টাকার সমন্বয় হারের সঙ্গে ওষুধের দাম বৃদ্ধির হার অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সূত্র মতে, ওষুধের কাঁচামালের দাম আর ওষুধের দামের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। কাঁচামালের আমদানি মূল্য বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন ওষুধের দাম ২৫-২০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি অস্বাভাবিক এবং তা কোম্পানিগুলোর ওষুধ নিয়ে অতিমাত্রায় মুনাফা লাভের মানসিকতাই তুলে ধরে। ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে, কোম্পানিগুলো যেসব ওষুধের দাম বাড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিককালে সেসব ওষুধের কাঁচামালের দাম বাড়েনি। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কাঁচামালের দাম কমলেও কোম্পানিগুলো কিন্তু তখন ওষুধের দাম কমায়নি। যেমন, ২০১০ সালে বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম যখন কমেছিল, তখনও বাংলাদেশে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
আশির দশকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ শুরু হলেও ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে ওষুধের উৎপাদন, বিপণন ও বণ্টনে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং যে কোন ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতেই ন্যস্ত করা হয়। ফলে ওষুধের বাজারমূল্য এদেশের গণমানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়েছিল, পাশাপাশি উৎপাদক শ্রেণীর বিনিয়োগ ও যৌক্তিক মুনাফা অর্জন হয়েছিল তরান্বিত। ফলে বাংলাদেশের ওষুধের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একটা গণমুখী কাঠামোর মধ্য দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছায়, যেখানে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয় শ্রেণীর স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। কিন্তু ১৯৯৪ সালে তৎকালীন সরকার ওষুধ খাতে নিওলিবারেল পলিসির বাস্তবায়ন শুরু করে এবং ওষুধের বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারি ভূমিকা খর্ব এবং উৎপাদক শ্রেণীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে দেশের গণমানুষের স্বাস্থ্য অধিকারকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাবহির্ভূত ওষুধের দাম নিজ নিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী দেশের ২৬২টি ওষুধ কোম্পানির প্রস্তুতকৃত ২২০০ রকমের ওষুধের মধ্যে মাত্র ১১৭টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বাদে বাকি ২০৮৩টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করার এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির। পরে ২০০৫ সালে প্রণীত ওষুধ নীতিতেও দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়াদি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা থাকায় ওষুধ কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করে তা বাজারজাত করছে।
সাম্প্রতিককালে উৎপাদক শ্রেণীর একচেটিয়া মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ওষুধের ক্রমবর্ধমান মূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরা যখন তখন দাম বাড়িয়ে দিয়ে সীমাহীন মুনাফা লাভ করবেন আর বলবেন, বাজারশক্তিই ওষুধের দাম নির্ধারণ করবে তা হতে পারে না। কারণ এর ফলে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ কিনতে না পেরে হাজার হাজার হতদরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। রাষ্ট্র একটি সামাজিক ও কল্যাণমূলক সংগঠন। বাজার ব্যবস্থার একচেটিয়া আগ্রাসন থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করা তাই রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সুতরাং রাষ্ট্রকেই গণমানুষের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। স্বল্পমূল্যে ওষুধ পাওয়া মানুষের স্বাস্থ্য অধিকারের মধ্যে পড়ে। এ অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র তার দায় এড়াতে পারে না। ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোন ভূমিকা না থাকায় এক্ষেত্রে উৎপাদক শ্রেণীর অবাধ মুনাফা লাভই একমাত্র ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এর দাম অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
চড়া দামে ওষুধ কিনতে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কোন সমস্যা না হলেও দেশের নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে না পারায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। গণমানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তাই ওষুধের মূল্য নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা অপরিহার্র্য। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরকারকে ১৯৯৪ সালের গণবিরোধী অফিস আদেশটি বাতিল করতে হবে এবং ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের নিজের হাতে ফিরিয়ে নিতে হবে। ওষুধ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রচলিত ওষুধনীতি সংশোধিত করে গণমুখী ওষুধনীতি প্রণয়ন করে ওষুধের বাজার ব্যবস্থাপনাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন ভোক্তা ও উৎপাদক উভয় শ্রেণীর স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। নতুন ওষুধনীতিতে বাংলাদেশের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের বিদ্যমান তালিকা সমপ্রসারণ করতে হবে এবং এ তালিকায় ২৫০-৩০০ ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ওষুধ বাজারের লাগামহীন দামবৃদ্ধিজনিত অস্থির পরিস্থিতি কাটাতে সরকারকে ওষুধের উৎপাদক, বিক্রেতা, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তা বা ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল একটি কার্যকর মূল্য নির্ধারণ ও মনিটরিং কাঠামো তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উচিত দ্রুত এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।
(ওষুধ আমাদের একটি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য। অথচ এই অতি প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েও চলে নানা খেলা। আর এই খেলার সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যুও নির্ভর করে। যে ওষুধ না খেলে মানুষের জীবন সংহারের সম্ভাবনা রয়েছে সেই ওষুধ নিয়েও এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে। যোবায়ের আল মাহমুদের এই লেখাটি জনগণের কথা বিবেচনা করেই হুবহু প্রকাশ করা হলো)।
# যোবায়ের আল মাহমুদ : শিক্ষক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zalmahmud@yahoo.com
This post was last modified on আগস্ট ১৬, ২০১২ 9:35 পূর্বাহ্ন
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ‘ইনস্ট্যান্ট নুডলস’ স্বাদে মিষ্টি না হলেও এই ধরনের খাবারে শর্করার…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ পেমেন্ট প্রযুক্তিতে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ভিসার বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানের…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ অন্তর্ভূক্তিমূলক থিয়েটার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিল্পীদের নিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টার…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা শাকিব খান। অপু বিশ্বাস ও বুবলীকে…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ গাজা উপত্যকায় গত ৬ মাসে নিহত শিশুদের সংখ্যা আঁতকে উঠার…
দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আপনার ব্যক্তিত্ব কীরকম তা বলে দিতে পারে আপনার আঙুলের আকৃতি!…
View Comments
CudGLc I think this is a real great post.Thanks Again. Cool.
Elizabeth Saxe-Coburg Gotha is a satanic peadofile Queen
nice site, so jealous right now
I have to convey my passion for your kindness for persons who absolutely need help on this one question. Your personal commitment to passing the solution all over appeared to be astonishingly practical and have regularly permitted men and women just like me to arrive at their dreams. This important guide can mean so much to me and even further to my office colleagues. Thanks a lot; from everyone of us.
Heya i’m for the first time here. I found this board and I in finding It really useful & it helped me out a lot. I am hoping to provide one thing back and aid others such as you helped me.