অনুপ্রেরণা: বাংলাদেশের ডাক্তাররাও চাইলে পারেন অনেক কিছুই

দি ঢাকা টাইমস্‌ ডেস্ক ॥ বিদেশ হলে এটা হতে পারতো অসাধারণ মেডিকেল সাকসেসের গল্প, কিন্তু নিজ দেশে এমন এক বিরল অপারেশন করার পরেও দুর্দান্ত এক মেডিকেল সাকসেস নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হয়নি। আজ আমরা সম্পূর্ণ ঘটনা তুলে আনবো দুর্দান্ত সেই অপারেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট এক ডাক্তারের লেখা থেকে।


প্রিয় পাঠক ঘটনাটি ঘটে হবিগঞ্জে, এবং সম্পূর্ণ ঘটোনার বর্ণনা উঠে এসেছে ডাঃ ফাইয়াদ মাহমুদে এক লেখায়, যা প্রকাশিত হয়েছে ডক্টরস ক্যাফে নামের এক ফেসবুক পেইজে। আমরা সম্পূর্ণ লেখা লেখকের অনুরূপ প্রকাশ করছি।

ঘটনাটা ঘটেছিলো হবিগঞ্জে। অ্যাটেমট টু মার্ডার। রাতের অন্ধকারে প্রতিপক্ষের একজন লোক মাছ ধরার টেটা বা কোঁচ ছুঁড়ে মারে পঞ্চাশোর্ধ লোকটির দিকে। লক্ষ্য ছিলো বুক বরারর। কিন্তু আঘাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তা সরাসরি বিদ্ধ হলো লোকটির বাম চোখে। হাতল আর কোঁচ সহ রোগীকে নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে সাবধানে কাঠের হাতলটি খোলা হলো। তবে জং পড়া ধাতব তীক্ষ্ণ অংশটি সেখানকার ডাক্তাররা ধরলেন না। রোগীকে পাঠানো হলো হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে। সেখানেও লোহার অংশটি বের করার চেষ্টা করা হলো না। রোগীকে রেফার করা হলো সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সিলেট মেডিকেলে তাঁকে ভর্তি রাখা হলো সে রাত। তবে সকালে ওয়ার্ডের রাউন্ডের পরই দ্রুত তাঁকে রেফার করা হলো ঢাকায়, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে। ততক্ষণে অবশ্য রোগীর বিপুল সংখ্যক আত্মীয়-স্বজনের ধৈর্য্যের বাঁধ টুটে গেছে। “সামান্য একটা লোহা চোখ থেকে বের করতে পারেনা এত্ত বড় মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা, এ কোন দেশে আমরা আছি”-এমন সব কথা নিরবে হজম করে যেতে হলো সিলেট মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে ইমার্জেন্সি ডিউটি অবস্থায় রোগীটিকে যখন রিসিভ করলাম, তখন সন্ধ্যা পার হয়েছে। রোগীর সাথে অনেক লোক। সবাই এবার নিশ্চিত চিকিৎসা পাবার অপেক্ষায় আছে। দেখলাম বাম চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। চোখে গেঁথে থাকা কোঁচটি আলতোভাবে ফিল করে দেখলাম বেশ শক্তভাবে তা চোখের কোটরে গেঁথে বসে আছে। আত্মীয়-স্বজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা লোহাটির দৈর্ঘ্য, আর গেঁথে থাকা অংশটার দৈর্ঘ্য মিলিয়ে আমার ভীষণ সন্দেহ হলো যে, লোহাটি চোখের কোটর বা অরবিট ভেদ করে মস্তিষ্কের সুরক্ষিত ভল্টে ঢুকে পড়েছে। এর সামান্য একটু অসাবধান নাড়াচাড়া রোগীর জন্য ভয়াবহ স্থায়ী ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। রোগীকে ঢাকা মেডিকেলের নিউরোসার্জারীতে রেফার করে রেফারেল লিখলাম। এবার ক্রোধে ফেটে পড়লো রোগীর স্বজনেরা। বাইরে শুরু হলো হৈচৈ আর জটলা। রোগীর দুজন আত্মীয়কে ডেকে বুঝিয়ে বললাম রিস্কের বিষয়টা। তারা বুঝলেও তাদের ক্ষোভ উগড়ে দিলো আমার কাছে। বাংলাদেশের সবচে’ বড় চোখের যায়গায় এসেও তারা সামান্য চিকিৎসাটুকুও পাচ্ছে না-এমন অভিযোগ তাদের। মোটামুটি অসহায়ভাবে তাদের কথায় সায় দিতে হচ্ছিলো। আলহামদুলিল্লাহ, শেষ পর্যন্ত কোন অঘটন ছাড়াই তাদের পাঠানো গেলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

Related Post

এরপরই শুরু হলো গল্পের আসল অংশ। ঢাকা মেডিকেল নিউরোসার্জারীতে সিটি স্ক্যান করে দেখা গেলো কোঁচের ধারালো অংশটি কোটর ভেদ করে মস্তিষ্কের ভল্টের বেশ গভীরে ঢুকে গেছে। মেডিকেলিয় ভাষায় ডায়াগনোসিসে লেখা হলো-Penetrating foreign body ‘TETA’ in left eyeball and orbit which intracranially extends upto middle cranial fossa with supra-sellar region.

পরদিন সকালেই রোগীটির অপারেশন করা হলো। নিউরোসার্জারী বিভাগ আর সাথে চক্ষু বা অফথাল্মোলোজি এবং অ্যানেস্থেশিয়া বিভাগ যৌথভাবে করলো এই অতি জটিল কাজটি। সোজা কথায় বলতে গেলে চোখ আর মাথার হাড় ছিদ্র করে এবং খুলে ফেলে লোহার স্পাইকটিকে সরাসরি দৃষ্টিসীমায় এনে, মস্তিষ্কের যেন সামান্যতম ক্ষতিও না হয়-সেভাবে বের করে আনা হলো প্রায় সাত ইঞ্চি লম্বা সেই কোঁচ বা টেটা। পুরো অপারেশনে সময় লাগলো সাড়ে চার ঘন্টা। অ্যানেস্থেশিয়ার আবহ কেটে যাবার পর দেখা গেলো সম্পূর্ণ সুস্থ্য আছে রোগী। সেখানে না থাকলেও বুঝতে পারছিলাম-এ এক অনন্য স্বস্তিকর আর তৃপ্তিদায়ক সংবাদ ছিলো নিউরোসার্জারী বিভাগের জন্য।

সাতদিন পর ঢাকা মেডিকেল থেকে ছাড়পত্র পেলো রোগী। এবার চোখের বাকী চিকিৎসার জন্য রেফার করা হলো জরুরী বিভাগ, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে। ভাগ্যক্রমে আবার আমার হাতেই পড়লেন তিনি। এবার তার সাথে লোক খুব কম। যারা আছে তাদের মুখে সলজ্জ হাসি।

ভাবলাম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সিকোয়েন্সগুলো। স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, হবিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, সিলেট মেডিকেল কলেজ ও আমাদের হাসপাতালে রোগীর আত্মীয়দের প্রবল চাপে কাবু হয়ে লোহাটি তোলার চেষ্টা করলে রোগীর মৃত্যু হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব ছিলো না। সিলেট মেডিকেল কলেজ আর আমাদের মতো টার্শিয়ারি লেভেল হাসপাতাল থেকে রেফার করাটা বোধ করি সবচেয়ে কঠিন। মানুষের প্রবল চাপ উপেক্ষা করে রোগীর ভালোর জন্য প্রতিটি স্তরে ডাক্তাররা যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার জন্য কেউ তাদের সামান্য ধন্যবাদ দেবেন, এটা সম্ভবত এদেশের কোন ডাক্তার আশা করেন না।

সবচেয়ে বেশী সহানুভূতি রইলো ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউরোসার্জারী বিভাগের জন্য। আল্লাহ্‌ তাদেরকে উত্তম বিনিময় দিন। এমন একটি অপারেশন আর টিমওয়ার্ক তারা দেখিয়েছে যে, আজ এই ঘটনা উন্নত কোন দেশে হলে সকল মিডিয়ায় এ নিয়ে সাড়া পড়ে যেতো। মেডিকেল জার্নালগুলো লুফে নিতো সাফল্যের এই কাহিনী। অথচ আজ হয়তো নিজেদের সার্কেলে তৃপ্তির হাসি বিনিময় ছাড়া এদের ভাগ্যে সামান্য ধন্যবাদটুকুও জুটবে না। এরকম আরো অগণিত কেসের মতো এই রোগীটির ফাইলও মেডিকেল রেকর্ড রুমের নিকষ কালো কক্ষে আটকা পড়ে থাকবে চিরদিনের জন্য।

নিকট ভবিষ্যতে মৃত্যুমুখ থেকে সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফেরা এই রোগীটির আত্মীয়রাই হয়তো বলবে, “কি অপারেশন করলো, চোখটাও বাঁচাইতে পারলো না”।
(রোগীর আহত অবস্থার টেটাবিদ্ধ চোখের বেশ কিছু ছবি আমি তুলে রেখেছিলাম। ভয়ংকর দর্শন বলে সেগুলো এখানে দিলাম না। সহজবোদ্ধ কিছু এক্সরে, সিটি স্ক্যান আর স্কাল-অরবিটের থ্রি ডাইমেনশনাল ছবি এখানে দিলাম). [ফিচার ইমেজ]
————–
লিখেছেন-
ডাঃ ফাইয়াদ মাহমুদ

This post was last modified on মার্চ ১৩, ২০১৫ 10:54 পূর্বাহ্ন

Zia

"বাপের টাকার হিসেবে বড়লোক, নিজের টাকার হিসেবে গরীব। আল্টিমেট আমি নিজেকে গরীব ভাবি। কারণ বাবার টাকায় ফুটানি মারিনা।"

Recent Posts

“ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে’: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার কঠোর নিন্দা জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী…

% দিন আগে

তুরস্কে বিড়াল পেল নাগরিকত্বের স্বীকৃতি!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় “তোমক” নামে এক জনপ্রিয় বিড়ালকে শহরের ‘সম্মানিত…

% দিন আগে

এক অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শুভ সকাল। বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ খৃস্টাব্দ, ২৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২…

% দিন আগে

শসার পুষ্টিগুণ জেনে নিন

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শসা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্যতম পরিচিত এবং সহজলভ্য একটি সবজি।…

% দিন আগে

অ্যাপল ও গুগল সাইবার হামলার বিষয়ে ব্যবহারকারীদের সতর্ক করেছে

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ অ্যাপল ও গুগল বিশ্বজুড়ে তাদের ব্যবহারকারীদের আবারও নতুন করে সাইবার…

% দিন আগে

টমেটোর গুণাগুণ জেনে নিন

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় সবচেয়ে পরিচিত ও সহজলভ্য একটি সবজি হলো…

% দিন আগে