দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ জামিদারী বাড়ির কথা শুনলেই অনেকের গা শিউরে উঠতে পারে। অনেকেই জমিদারী মানেই বোঝেন একনায়ক এক ব্যক্তির ‘হুঙ্কার’। কিন্তু আসলে কি তাই? জমিদারী বাড়িগুলো এখনও আমাদের দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে। এগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। এমন এক জমিদারী বাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাহবুবুল হাসান।
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হইতে শুধু দুইপা ফেলিয়া…”
রবি বাবুর কবিতার মতো আমরা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কত কিছুই যে চোখ থাকতেও দেখতে পাচ্ছি না তার হিসেব করাই মুশকিল। নাগরিক ব্যস্ততা ও শত প্রতিকূলতার মাঝেও একটি দিন সময় বের করে চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পাবেন এ ধরনী কত সুন্দর।
এবার ঈদে বন্ধুদের সাথে দেখা না হওয়ায় ক্যাম্পাস খোলার সাথে সাথেই সবাই মিলে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করলাম। কিন্তু ততদিনে আবার সেই একঘেয়ে ক্লাসগুলো শুরু হয়ে গেছে। সময়টা খুবই বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল তাই ক্লাস-এক্সাম সব কিছুকে ছুটি দিয়ে একদিন বের হলাম, উদ্দেশ্য ঢাকার মধ্যেই অন্যরকম একটা দিন কাটানো। সাথে দুই বন্ধু সোহেল ও তপু।
নতুন কোন জায়গা দেখার উদ্দেশ্য তাই প্রথমে বাসে করে চলে এলাম আশুলিয়া। এরপর মিরপুর বেড়িবাধ থেকে নৌকায় তুরাগ নদী পার হয়ে নামলাম বিরুলিয়ায়। প্রাচীন এই গ্রামটি বর্ষায় পুরোপুরি দ্বীপে পরিণত হয়েছে, তাই এডভেঞ্চারটাও ছিল একটু বেশি।
সামনে যেতেই চোখে পড়বে এই সুরম্য অট্টালিকা
উপনিবেশিক যুগের শতবর্ষী চমৎকার অনেকগুলো ভবন এই গ্রামে রয়েছে। ভাওয়াল রাজার জমিদারির একটি অংশ ছিল এই বিরুলিয়া গ্রাম। কলকাতার বিশ্বখ্যাত আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের কর্ণধারদের পূর্বপুরুষরাসহ এখানে বাস করতেন নিতাই বাবু, গোপী বাবু, রজনী ঘোষ, তারকচন্দ্র সাহা প্রমুখ ধনাঢ্য ব্যবসায়ীগণ। তাদের মতো জমিদারদের বজরা, জাহাজ ভিড়ত এই বিরুলিয়ার ঘাটে। এখানে বসে বংশাই, ধলেশ্বরী, তুরাগ নদী পথে তারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কত জমজমাট ছিল একটি সময় এই গ্রাম, আর আজ আমরা এই প্রাচীনতার গন্ধে মাখা গ্রামের পথে হেঁটে চলেছি ভাবতেই বারবার শিহরিত হচ্ছিলাম আমরা তিনজন।
এরপর চোখে পড়বে ১৯৯৪ সালে নির্মিত বিরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। ঠিক শত বছরের স্বাক্ষী এই বিদ্যালয়ের পাশেই আপনি দেখতে পাবেন এই ভবনটি যার সাথেই রয়েছে একটি মন্দির।
গ্রামের পথ ধরে হেটে চললাম আমরা। বহু পুরোনো কিছু মাটির বাড়িও আমাদের নজর কেড়েছিল। আরেকটু সামনে গিয়েই চোখে পড়ল প্রায় ৮৫ বছরের পুরোনো শ্রী শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্র জিউ বিগ্রহ মন্দিরটি।
যতই দেখছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম আমরা। বারবার মনে হচ্ছিল যদি সত্যিই টাইম ট্রাভেল করা যেত! আর চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠছিল জমিদারদের আভিজাত্যের উপমা। কতটা শৈল্পিক আর অভিজাত হলে সেই প্রাচীনকালে এমন বাড়ি বানানো যায়! এমনিসব অসাধারণ বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন রয়েছে এসব বাড়িতে।
সুরম্য এই বাড়িটির পাশে সযত্নে বেড়ে ওঠা এই তুলসী গাছটি যেন আমাদেরকে ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’-র কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় জমিদাররা এসব কষ্টার্জিত সম্পত্তির মমতা ছেড়ে পাড়ি জমান ভারতে। এমনটিই জানালেন জন্মের পর থেকেই এই গ্রামে বেড়ে ওঠা প্রায় শতবর্ষী এই বৃদ্ধ চাচা। বললেন, সেই সময়ের অনেক কথা চোখ বন্ধ করলেই যা তিনি স্বপ্নের মতো দিব্যি দেখতে পান। আমরাও বার বার কল্পনায় ভেসে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম সেই সময়ে।
পুরো গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকা এমনিসব অসাধারণ নজরকাড়া প্রাচীন ১২টি ভবন আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল এক ভিন্ন জগতে। কখন যে সূর্য মামা পশ্চিম দিকে হেলে গিয়ে ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে টেরই পাইনি আমরা।
নৌকায় করে ফিরতে ফিরতে দেখছিলাম বিরুলিয়া গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও নিকটবর্তী শতবর্ষী এই বটগাছটিকে। পূর্বপুরুষদের পৈতৃক ভিটার পাশের এই বটগাছের ছবি টানানো রয়েছে কলকাতার আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের শোরুমে। আজও এখানে বৈশাখী মেলা বসে। আর নানান রকম ভূতের কল্প-কাহিনীতো আছেই একে ঘিরে!
গ্রামটি ছেড়ে আসতেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ফিরতেই যে হবে, তাই নৌকায় চেপে বসলাম আমরা। নৌকা ছাড়ার পর মনে হচ্ছিল যেন আমাদেরকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে জমিদাররা। শত হলেওতো জমিদারির আতিথেয়তাতো! প্রত্যাশার চেয়েও প্রাপ্তিটা মনে হয় একটু বেশিই ছিল।
প্রাচীন এই গ্রামে অতীতে হারিয়ে যেতে চাইলে ব্যস্ততা থেকে একটি দিন নিজেকে ছুটি দিয়ে ঘুরে আসতে পারেন।
যেভাবে যাবেন:
মিরপুর বেড়িবাধ ধরে আলিফ এন্টারপ্রাইজ বা যেকোন হিউম্যান হলার বিরুলিয়া ঘাটের সামনে দিয়েই যায়, হেলপারকে বললে নামিয়ে দিবে। আর প্রাইভেটকার বা সিএনজি নিয়ে গেলে আপনি মিরপুরের দিক থেকে আসুন অথবা আশুলিয়ার দিক থেকেই আসুন বেড়িবাধ ধরে মাত্র ৭/৮ মিনিট এগোনোর পরেই বিরুলিয়া ঘাটের দেখা পাবেন। ঘাট থেকে নৌাকায় করে চলে যাবেন বিরুলিয়া গ্রামে।
সাবধানতা:
গ্রামটি দ্বীপের মতো হওয়ায় এখানে প্রচুর কুকুরের দেখা মেলে। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এখানকার কুকুরগুলো খুবই শান্ত প্রকৃতির। গ্রামে একটা পুলিশ ফাঁড়ি থাকায় এটি যথেষ্ট নিরাপদ। আর গ্রামবাসীও যথেষ্ট অতিথিপরায়ণ। তবে খাওয়া- দাওয়া করার জন্য ভালো কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্ট ধরনের কোন কিছুই আপনি এখানে পাবেন না। খাওয়া-দাওয়া করতে হবে গ্রাম থেকে বের হয়ে এসে। ভালো কিছুর দেখা পেতে হলে এটুকু ত্যাগ স্বীকার না করলে চলে! শুভ হোক আপনার ভ্রমণ।
# মাহবুবুল হাসান
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা- ১৩৪২।
ফেসবুক লিংক: www.facebook.com/mahbubulhasan.ju