দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বাজারে এখন লিচু ও আমসহ নানা ধরনের ফল পাওয়া যাচ্ছে। লিচু খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। তবে আম থাকবে অনেকদিন। কিন্তু বাজারের এসব ফল আসলে কি স্বাস্থ্যসম্মত? সেই বিশ্লেষণ নিয়েই তৈরি করা হয়েছে আজকের এই রিপোর্ট।
প্রমমে আসা যাক লিচুর প্রসঙ্গ নিয়ে। সর্বত্রই এখন রসে ভরপুর লিচুর একচ্ছত্র দাপট। বাজারে, আড়তে, ফুটপাতে ক্ষুদে ব্যবসায়ীর ডালায় ডালায় পসরা লাল-খয়েরির মেলা। দিনাজপুর ও রাজশাহীর লিচুতে রাজধানীর বাজার সয়লাব। পথ চলতে চোখে পড়লেই কম-বেশি লিচু কিনে নেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন। কিন্তু পরিবার-পরিজনের জন্য লিচুর নামে বিষই যে কেনা হচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা কী জানা গেছে, শুধু লিচু নয়, আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস থেকে শুরু করে আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। তবে লিচু ও আমে বাগানেই কেমিক্যাল মিশিয়ে সরবরাহ করা হয়। পরে আরও কয়েক দফায় বিভিন্ন স্থানে কেমিক্যাল মেশানো হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমের আম এখনো পুরোপুরি পাকতে শুরু করেনি। কিন্তু রাজধানীর সর্বত্র ‘পাকানো আমে’ সয়লাব। দামও খুব নয়, ফলে বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। আম পাকানোর জন্য কেমিক্যাল সহজলভ্য। প্রভিট, ইডেন, ইথরেল প্রভৃতি কেমিক্যাল ব্যবহারে সব আমেই হলুদ রং ধরে যায়। ফল আড়তদাররা দাবি করেন, ‘প্রশাসনিক নজরদারির কারণে ঢাকায় কেমিক্যাল দিয়ে ফল পাকানোর কর্মকাণ্ড বন্ধ। তবে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদিত হওয়া অঞ্চলেই কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। আম ও লিচুতে বাগানেই নাকি কেমিক্যাল মেশানো হয়।’ কাঁঠালের বিরুদ্ধে তেমন কোন অভিযোগ না থাকলেও বাজারের টমেটো নিয়েও রয়েছে অনেক অভিযোগ। মেডিসিন দিয়ে অনেকদিন অক্ষত রাখা যায় টমেটো। এসব কেমিক্যাল মানব দেহের জন্য প্রচণ্ড ক্ষতিকর।
বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ওইসব দৈনিকে বলা হয়, হাইকোর্ট এক নির্দেশনায় বাজারে কেমিক্যাল মেশানো ফল বিক্রি হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারকে বললেও এখন পর্যন্ত সেই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘নানা রাসায়নিক পদার্থযুক্ত বিষময় ফল ধীরে ধীরে লিভার ও কিডনি অকেজো করে দিতে পারে। এসব কেমিক্যাল হার্ট দুর্বল করে দেয়। ব্রেন ন্যুব্জ করে স্মৃতিশক্তিও কমিয়ে দেয়। অস্বাভাবিকভাবে এসিডিটি বাড়ায়। ফরমালিনযুক্ত খাদ্য নিয়মিত গ্রহণ করলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার, এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হতে পারে।’
বর্তমানে যেসব ফল বাজারে দেখা যাচ্ছে তার রং এতই উজ্জ্বল যে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। বিক্রিও হয় বেশি দামে। তাই অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তরের জন্য অধিক ক্ষারজাতীয় টেক্সটাইল রং ব্যবহার করা হয়। আরও ভয়ঙ্কর খবর হলো, ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত অন্তত ৬ দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাস-জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন-জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের কারণে পুরো ফলই রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করতে ফরমালিনসহ আরও কিছু বিষাক্ত পদার্থের ব্যবহার হচ্ছে। বাগান মালিকরা লিচুর মুকুল আসার আগেই ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এরপর লিচু ভাঙা পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি ও পোকার হাত থেকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন কীটনাশক ও ভিটামিন ব্যবহার করে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার রোধে কৃষি অধিদফতর থেকে কর্মকর্তাদের বিশেষ সতর্কতামূলক চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক কেমিক্যাল স্প্রের উদ্যোগ নেওয়া হলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় অভিযান চালাতে হবে। কিন্তু লিচুপ্রধান এলাকাগুলোয় কৃষি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চাষিরা ক্ষতিকর কীটনাশক ও কার্বাইড ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। লিচুর জন্য বিখ্যাত দিনাজপুরের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবু মো. মহসিন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা লিচু পাকানো ও রং ভালো করতে উচ্চমাত্রার কার্বাইড ব্যবহার করেন, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে, মিনকারা, ছত্রাকনাশক ব্যাভিস্টিন পাউডার, ভিটামিন নাফা, ওকোজিম, ফ্লোরা ও ট্রমিস্ট্রিন লিচু বড় করার জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এগুলো ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কম।’
আম চাষের সঙ্গে যুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বালুরবাগান এলাকার কৃষক হাসেম আলী জানান, গাছে গুটি আসার পর কীটপতঙ্গের হামলা ঠেকাতে আম চাষিরা বিভিন্ন কীটনাশক দেন। আম বড় হলে সুন্দর রঙের জন্য ব্যবহার করেন একধরনের পাউডার, যা ‘সেভেন পাউডার’ নামে পরিচিত। আম তোলার পর ময়লা পরিষ্কার করতে ব্যবহার হয় ‘নয়ন পাউডার’, এরপর ব্যবসায়ীরা বেশি দিন তাজা রাখতে আরও কয়েক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করেন। রাজশাহী এলাকার শতাধিক ব্যবসায়ী ভারতীয় উচ্চমাত্রার নানা কেমিক্যাল চোরাপথে এনে আম ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব কেমিক্যালযুক্ত লিচু ও আম রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেও নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রায় নিশ্চুপ। সঠিক আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে এসব অখাদ্য-কুখাদ্য বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।