দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ পৃথিবী হলো রহস্যময় একটি গ্রহ। যার আনাচে কানাচে রয়েছে নানা রহস্য। যুগে যুগে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সাহায্যে নানা রহস্যের উন্মোচন হয়েছে। তবুও এমন অনেক রহস্য রয়েছে যা এখনো উন্মোচন হয়নি। তেমনি একটি রহস্যময় স্থান হল পেরুর নাজকা লাইন। যার মূল রহস্য বিজ্ঞানীরা এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। তাহলে চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই নাজকা লাইনে।
নাজকা রেখা হল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর দক্ষিণাঞ্চলে নাজকা মরুভূমিতে অঙ্কিত কিছু বিশালাকৃতির ভূ-রেখাচিত্র বা জিওগ্লিফ। এই মরুভূমির প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ১০ হাজারেরও বেশি অঙ্কিত রেখা রয়েছে। ইউনেস্কো ঘোষিত পেরুর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে এই নাজকা রেখাগুলো স্থান পেয়েছে। পেরুর ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানও বলা যায়। নাজকা মালভূমি জুড়ে অঙ্কিত এসব ভূচিত্রগুলো এত বিশাল যে, আকাশ থেকে না দেখলে সেগুলোর কাঠামো বোঝা যায় না। তবে আশেপাশে অবস্থিত উঁচু পর্বতের পাদদেশ বা সেই রকম উচ্চতার কোন স্থান থেকেও এগুলো দৃষ্টিগোচর হয়। নাজকা মরুভূমির মাঝ বরাবর রয়েছে একটি লম্বা সরলরেখা, যার দুপাশ বেয়ে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর গেছে কিছু সমান্তরাল রেখা। সেখানে রয়েছে বিশাল আকৃতির ত্রিভূজ, চতুর্ভুজ, আয়তক্ষেত্র, সামন্তরিকের মত নানা জ্যামিতিক নকশা। কাছ থেকে দেখলে এখানকার ৯০০’র ও বেশি জিওগ্লিফগুলোর পাশাপাশি রয়েছে পাখি, বানর, কুকুর, তিমি, মাকড়সা ইত্যাদির মতো ৭০টি প্রাণী এবং ৩০০টির ও বেশি ভৌগলিক আকৃতি।
১৫৫৩ সালে পেরুর একজন লেখক-গল্পকার ‘পেদ্রো সিজা ডে লিয়ন’ এর একটি বইয়ে প্রথম নাজকা লাইনের উল্লেখ করেন। লেখক বইটিতে অবশ্য এই রেখাগুলোকে ভুলবশত পথনির্দেশক রেখা বলে উল্লেখ করেন। এর পরে আঠার শতকের দিকে পেরুর এক পাইলট নাজকা মরুভূমির উপর দিয়ে উড্ডয়নের সময় আকাশ থেকে লক্ষ্য করেন এ রেখাগুলো। কারণ রেখাগুলো এতটায় বৃহৎ যে, ভূমি থেকে এর প্রকৃত কাঠামো বোঝার উপায় নেই। এরপর ১৯২৭ সালে পেরুর আর্কিওলজিস্ট ‘তোরিবিও মেজিয়া জেসপ’ নাজকা মরুভুমি পরিদর্শনের সময় একটি উচুঁ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে রেখাগুলি দেখতে পান। বিশালাকার রেখাগুলি তোরিবিওর মনে কৌতুহল সৃষ্টি করে।
১৯৪০-৪১ সালে আমেরিকার ঐতিহাসিক ‘পল কসক’ বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার সেচ-প্রণালী নিয়ে গবেষণার কাজে পেরুতে আসেন। সেসময় তিনি নাজকা রেখার উপর দিয়ে প্লেনে উড়ে যাবার সময় রেখাগুলোর মাঝে পাখির মতো একটা আকৃতি লক্ষ্য করেন এবং এ রেখাগুলো নিয়ে তার মনে কৌতুহল জাগে। তিনি এই রেখাগুলো নিয়ে গবেষণাকাজ শুরু করলে তার সঙ্গে যোগ দেন জার্মান গণিতজ্ঞ ও আর্কিওলজিস্ট মারিয়া রাইখ। তারপর বিভিন্ন আর্কিওলজিস্ট আর গবেষকদের উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এই নাজকা লাইন। আবিষ্কৃত হতে থাকে নানা আকৃতির রেখা। এ রেখা সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে।
প্রকৃতপক্ষে নাজকা রেখা কাদের আঁকা এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে বেশিরভাগ গবেষকদের ধারণা, নাজকার স্থানীয় অধিবাসীরা খিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নাজকা মরুভূমিতে রেখাগুলো অঙ্কন করে। আবার আরেক দল গবেষকরা মনে করেন, ইনকা সভ্যতার শুরু এই অঞ্চল থেকে। ইনকা সভ্যতার লোকেরা তাদের মেধা, শ্রম, দক্ষতা আর সময় ব্যয় করে এঁকেছিল এ রেখাগুলো। আবার অনেকের ধারণা ভীনগ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীতে এসে তাদের পথনির্দেশিকা হিসেবে অঙ্কন করেছিল নাজকার রেখাগুলো।
শুধু কারা এঁকেছিল তাই নয়, কীভাবে এই দানবাকৃতির রেখাগুলো অঙ্কন করা হয়েছে তা নিয়েও মতভেদ আছে। হাজার হাজার বছর পূর্বে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোন ছোঁয়াই ছিল না মানুষের জীবনে, তখন কিভাবে অঙ্কন করা হয়েছিল রেখাগুলি! কারণ এই বৃহৎ রেখাগুলি যা প্লেন থেকে বা উচু পর্বতের পাদদেশে না উঠলে স্পষ্ট বোঝা যায় না। সেই রেখাগুলো কিভাবে তারা অঙ্কন করেছিল। এক্ষেত্রে কিছুটা এলিয়েনদের কথা ভাবতে হয়। কারণ প্রাচীনযুগে এমন কষ্টসাধ্য নকশা মানুষের দ্বারা তৈরি তা ভাবতে কিছুটা সন্দেহ হয়। নাজকা মরুভূমি লালচে আয়রন অক্সাইড সমৃদ্ধ নুড়ি পাথর দ্বারা আবৃত। এর নিচে রয়েছে চীনামাটির স্তর। সম্ভবত, ভূমির উপরিভাগের শক্ত পাথুরে মাটি খুঁড়ে কাঠ বা পাথরের ধারালো টুকরা দ্বারা আঁকা হয়েছে নাজকা রেখাগুলো। এ রেখাগুলো চার থেকে ছয় ইঞ্চি গভীর। সাধারণ মাটিতে আঁকলে বায়ুপ্রবাহ, ভূমিক্ষয়, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি প্রকৃতিগত পরিবর্তনে মুছে যেত রেখাগুলো অনেক বছর আগেই। কিন্তু নাজকা মরুভূমির চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া আর ভূপ্রকৃতির কারণে বায়ূশুন্য, শুষ্ক, আর প্রায় বৃষ্টিহীন মাটিতে হাজার হাজার বছর পর আজও রেখাগুলো অক্ষত রয়েছে। হয়ত একদিন এই রহস্যও উন্মোচন হবে। তবে তার কিছুটা কৌতুহল আজিবন থেকেই যাবে। অবশ্য কিছু রহস্য না থাকলে পৃথিবীকে আর রহস্যময় পৃথিবী বলা যাবে না। এভাবেই পৃথিবীতে রহস্যের উন্মোচন হবে আবার নতুন রহস্যের সৃষ্টি হবে। আর এই রহস্য উন্মোচনের জন্যই মানুষ কৌতুহলী হয়ে থাকবে।