দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ কিডনি ডায়ালাইসিস মানেই এক বিশাল খরচের ব্যাপার। বিশেষ করে গরীব রোগিদের পক্ষে এই ডায়ালাইসিস করাটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে এবার বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে দেশে কিডনি ডায়ালাইসিস করা হচ্ছে। পূর্বের খরচের থেকে চার ভাগের এক ভাগ মাত্র খরচ করতে হচ্ছে।
জানা গেছে, এই স্বল্প খরচে ডায়ালাইসিস করছে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। বিনামূল্যে ও অত্যন্ত কম খরচে রোগীদের ডায়ালাইসিস করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে কিডনি ডায়ালাইসিস করার মতো খরচ বহন করার মানুষের সংখ্যা অনেক কম। অনেক গরীব রোগি আছে যারা টাকার জন্য ডায়ালাইসিস করতে পারেন না। তবে এখন খরচ কমে আসায় অনেকেই আশ্বস্ত হচ্ছেন। অন্তত ডায়ালাইসিস করার মাধ্যমে প্রিয়জনদের বাঁচিয়ে রাখার পথ পেয়েছেন। এতে করে গ্রামাঞ্চলের বা নিম্ন আয়ের মানুষ যাদের কিডনি সমস্যা রয়েছে তারা উপকৃত হচ্ছেন।
আগে তাদের সপ্তাহে ডায়ালাইসিস করতে খরচ পড়তো ৫ হাজার ১০০ টাকা। যারা দূর থেকে আসেন তাদের আসা-যাওয়া এবং ওষুধের জন্য আরও প্রায় ৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হতো। সব মিলিয়ে ‘প্রতি সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা তাদের ব্যয় করতে করতে হতো। এতে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
বর্তমানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১ হাজার ১০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করানো যাচ্ছে। এই হাসপাতালে নিবন্ধন করে ডায়ালাইসিস করা সম্ভব হচ্ছে অস্বচ্ছল রোগীদের। শুধু তাই নয়, যারা একেবারেই অস্বচ্ছল কর্তৃপক্ষ সেসব পরিবারের নিঃস্ব অবস্থা জানার পর ডায়ালাইসিস হচ্ছে বিনামূল্যেও! অনেক অস্বচ্ছল পরিবারকে ‘ডায়ালাইসিস ফ্রি, অন্যান্য পরীক্ষা এবং ওষুধও ফ্রি’ প্রদান করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যে কারণে দূর থেকে আসা রোগীদের আসা-যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো খরচ নেই। এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মানবিক দৃষ্টিকোণ দেখে অনেকেই আশান্বিত হয়েছেন। বিশেষ করে যাদের সামর্থ নেই ডায়ালাইসিস করানোর তারা নতুন করে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।
হাসপাতালে কর্মরত জ্যেষ্ঠ মেডিকেল কর্মরত এক কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে শয্যা রয়েছে ১০০টি। প্রতিবার (এক কিস্তিতে) ৯০ জন রোগীর জন্য শিডিউল দেওয়া থাকে। প্রতিবার ৫ জন রোগী বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা পেয়ে থাকেন।
১৩ মে হতে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে এই ডায়ালাইসিস কেন্দ্র চালু হয়েছে। এখন দেশে এটিই সবচেয়ে বড় ডায়ালাইসিস কেন্দ্র। প্রতিদিন তিন কিস্তিতে ২৩০ হতে ২৪০ জন রোগী এখানে ডায়ালাইসিস করাতে পারছেন। এ পর্যন্ত ৬০০-এর বেশি রোগী এখানে নিবন্ধন করেছে। অধিকাংশ রোগীকেই সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই উদ্যোগকে সকলেই স্বাগত জানিয়েছেন। বিশিষ্ট কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেছেন, ‘দেশে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেক কিডনি রোগী রয়েছে, যাদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস করা প্রয়োজন। ডায়ালাইসিস দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হয়। তবে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় গরীব রোগীদের পক্ষে তা চালানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই গণস্বাস্থ্যের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু বিনামূল্য বা স্বল্প মূল্যের কারণে চিকিৎসার মানে যেনো ঘাটতি না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকাটা জরুরি।’
দেশে কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটির মতো। তাদের মধ্যে কিডনি বিকল হয়েছে এমন রোগী রয়েছে ৮ লাখ। তাদের কিডনি ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন করা জরুরি। অথচ সব মিলিয়ে ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পাচ্ছে মাত্র ১৮ হাজার রোগী। দেশে সরকারি এবং বেসরকারি ১০১ একটি কেন্দ্রে ডায়ালাইসিস করা হয়। অথচ রোগীর অনুপাতে প্রয়োজন কমপক্ষে এক হাজার কেন্দ্র।
জানা গেছে, ডায়ালাইসিস কেন্দ্রের মধ্যে সরকারের জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি হাসপাতালের ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে রোগীর ডায়ালাইসিস খরচ সবচেয়ে কম। এই দুটি কেন্দ্র চলে ভারতের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে। প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য রোগীকে মাত্র ৪০০ টাকা দিতে হয়, এক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দেয় ১ হাজার ৭০০ টাকা। বেসরকারি সব কেন্দ্রে ডায়ালাইসিস ব্যয় গড়ে দুই হাজার টাকারও বেশি।
সহযোগী সংবাদ মাধ্যমকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘রাজধানীর মিরপুরের কিডনি ফাউন্ডেশনে নিজে ডায়ালাইসিস করার সময় অন্য রোগীদের নিকট হতে অসহায়ত্বের কথা জেনেছি। দেখলাম চিকিৎসা রয়েছে অথচ মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। মানুষের কাছে ডায়ালাইসিস সেবা সহজলভ্য করার জন্য আমি এই কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নিই।’ এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তি গণস্বাস্থ্যকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা অর্থ সহায়তা দিয়েছেন।
জানা গেছে, রোগীকে ডায়ালাইসিসের জন্য নিবন্ধন করার পূর্বে তার আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন করে থাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। হতদরিদ্র মানুষের কাছ থেকে কোনো অর্থই নেওয়া হয় না। দরিদ্র মানুষের নিকট হতে প্রতি সেশনের জন্য ১ হাজার ১০০ টাকা, মধ্যবিত্তের নিকট হতে ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং উচ্চবিত্ত বা ধনী রোগীদের নিকট হতে নেওয়া হয় ৩ হাজার করে। চালু হওয়ার পর হতে এই কেন্দ্রে আসা রোগীর মধ্যে দরিদ্র রোগীর সংখ্যা ১০০ জনও হয়নি।
এ বিষয়ে জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘বেশ কিছু কারণে দরিদ্র রোগীরা আসছে না বলে আমাদের ধারণা। অনেকেই জানে না যে বিনামূল্যে এই চিকিৎসা পাওয়া যায়। আবার অনেকের ঢাকার বাইরে থেকে আসা-যাওয়ার খরচ বহন করার সামর্থ্যও নেই। আমরা কমপক্ষে ২০০ দরিদ্র রোগীকে বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস করতে পারবো। সরকার বিদ্যুৎ, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম কমালে আরও কমমূল্যে এই সেবা দেওয়া সম্ভব।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘তবে ডায়ালাইসিস স্থায়ী সমাধান না। একজন মানুষ সারা জীবনই ডায়ালাইসিস করে যাবে, এটা খুব কষ্টকর ব্যাপার। তাই আমরা ভাবছি কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করার কথা। এ ক্ষেত্রেও আমরা আর্থিক বিষয় বিবেচনায় রেখে সবচেয়ে কমমূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করবো। আশা করছি ২০১৮ সালে প্রতিস্থাপন শুরু হবে।’