Dhaka Times Desk ‘৩ মাস আগেই তা খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে’, এই নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এতে করে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারনা করছেন।
অর্থনীতিবিদদের উদ্বৃতি দিয়ে সমপ্রতি একটি দৈনিক বলেছে, এ নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশের ব্যাংক খাত ছাড়াও সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। ব্যবসায়ীরা টাকার সংকটে পড়বেন। এতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার আরও বৃদ্ধি পাবে। হাজার হাজার সফল ব্যবসায়ীর গায়ে ঋণ খেলাপির কালিমা পড়বে। হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখিত নীতিমালা ব্যাংকগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়ার ফলে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি ব্যবসায়ী মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ীকে ঋণ খেলাপির খেতাব পড়ানো হবে। এছাড়া ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীরা মনে করেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে ভয়াবহভাবে তারল্য সংকট বিরাজ করছে। ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে বেশি হারে। এতে ব্যাংকের ঋণযোগ্য তহবিলের পরিমাণ অনেক কমে আসবে, যা তারল্যের ওপর চাপ আরও বাড়াবে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উল্লেখিত নীতিমালা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর-৭ ও ৮-এর মাধ্যমে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ঋণ শ্রেণীবিন্যাস, ঋণ পুনঃসূচিকরণ এবং ডাউন পেমেন্ট সংক্রান্ত যে নতুন নিয়ম প্রবর্তন করা হয়েছে তাতে দেশের রফতানিসহ যে কোন ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখা সম্ভব হবে না বলে এফবিসিসিআই মনে করে। আজ বুধবার এফবিসিসিআই লিখিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ নীতিমালা প্রত্যাহারের দাবি জানাবে।
বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত-এর উদ্বৃতি দিয়ে রিপোর্টে আরও বলা হয়, এ নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যাংক খাত ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ এটা করেছে মূলত আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী। এটা নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতির বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকবে। ব্যবসায়ীরা টাকার সংকটে পড়বে। ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বন্ধ হওয়ার আশংকা থাকবে। এতে শিল্পাঞ্চলে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। যার ফলে বিনিয়োগ আরও কমে যেতে পারে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নীতিমালা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে না।
এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদ বলেন, ইউরো জোনসহ ওইসিডিভুক্ত দেশগুলো ভয়াবহ ঋণসংকটের কারণে চরম অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত হওয়ায় এসব দেশে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে রফতানিমুখী শিল্পখাতগুলো সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে তীব্র জ্বালানি সংকট, কঠোর মুদ্রা সংকোচন নীতি, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণজনিত তারল্য সংকট এবং ব্যাংকসুদের উচ্চহার দেশের সমগ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে সংকটে নিপতিত করেছে। সংকুচিত মূদ্রানীতির কারণে একদিকে যেমন নতুন শিল্পায়ন বা বিনিয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে জ্বালানির অপর্যাপ্ততার কারণে বিদ্যমান সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদনশীল খাত সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে কর্মসংস্থান বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যমান মুদ্রা সংকোচন নীতির সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ঋণ শ্রেণীকরণ, পুনঃসূচিকরণ ও ডাউন পেমেন্ট সংক্রান্ত সার্কুলারের কারণে রফতানিমুখী শিল্পসহ সব শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়বে এবং দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। একে আজাদ আরও বলেন, এমতাবস্থায় বর্তমান আন্তর্জাতিক ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর-৭ ও ৮ প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট আগের সার্কুলার বহাল রাখতে হবে। এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, এতদিন যে নিয়ম চলে আসছে হঠাৎ করে তা পরিবর্তন করা হলে তাতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ও হার অনেক বাড়বে। তারা বলেন, অনেক ব্যবসায়ী যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের মানসিকতা থাকলেও নানা কারণে ছয় মাস সময় নেন। অনেক ক্ষেত্রে ভালো উদ্যোক্তা হলেও ব্যবসায় সমস্যার কারণে বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করেন। নতুন নীতিমালায় পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে নিয়ম আরও কঠোর করা হয়েছে। হঠাৎ করে এ নিয়ম মানতে গেলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে সমস্যা হবে।
এফবিসিসিআই’র উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, এ নীতিমালার ফলে ঋণ খেলাপি হবেন না, এমন ব্যবসায়ী পাওয়া দুরূহ হবে। তিনি উল্লেখ করেন, এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমসিম খাচ্ছে অনেকে। ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়ার সক্ষমতা হারাচ্ছেন কেউ কেউ। বর্তমান অবস্থায় ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য সময় বাড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু করা হয়েছে তার উল্টো। এ নীতিমালার ফলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা সৃষ্টি হবে। এতে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বিনিয়োগ কমে যাবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুশের্দী বলেন, এ নীতিমালার বাস্তবায়ন হলে দেশের লাখ লাখ সফল ব্যবসায়ীর গায়ে ঋণ খেলাপির দাগ পড়বে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দার এ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে সাবির্ক অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেবে। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় সময় বাড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু সময় কমানো হয়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হবে। বিনিয়োগ কমে যাবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে। ফলে জিডিপি গ্রোথ কমে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে চিঠি দেয়া হবে। এদিকে খেলাপি ঋণ বা শ্রেণীকৃত ঋণ, পুনঃতফসিলীকরণ ও প্রভেশনিং নীতিমালা এখনই বাস্তবায়ন করতে নারাজ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এ নীতি বাস্তবায়নে আরও সময় চেয়ে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করবেন ও চিঠি দেবেন সংগঠনের নেতারা।
উল্লেখ্য, আগে ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় পার হলে ঋণ শ্রেণীকরণ বা খেলাপি ঋণ হিসেবে গণ্য করা হতো নতুন নীতিমালা অনুযায়ী আগের চেয়ে ৩ মাস আগেই তা খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে। ফলে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নিম্নমান (সাব-স্ট্যান্ডার্ড), সন্দেহজনক (ডাউটফুল), মন্দ বা ক্ষতি (ব্যাড) ঋণের শ্রেণীমান নির্ধারণে মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা আগের চেয়ে ৩ মাস করে কমিয়ে আনা হয়। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে হল নিম্নমান, ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে সন্দেহজনক ও ৯ মাসের বেশি হলে মন্দ বা ক্ষতি মানে শ্রেণীকৃত হবে বলে জানানো হয়। নতুন এ নীতি ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করার কথা।
এ ব্যাপারে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এক কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে আলাপ হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও জানায়নি। তাই ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী এ বিষয়ে তাদের যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা ও শৃংখলা আনতে এ নীতি করা হয়েছে। এটা অনেক বাস্তবভিত্তিক। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে নতুন এই নীতিমালা। সারা বিশ্বে এই নীতি অনুযায়ী ঋণ শ্রেণীকরণ করা হয়।