The Dhaka Times Desk পৃথিবীর অনেক রহস্যের এক রহস্য সানসিংতুন সভ্যতা। এই সভ্যতার কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছে আজকের চিত্র-বিচিত্র।
ইতিহাসের অনেক কাহিনীর মধ্যে এটিও একটি কাহিনী। রহস্যঘেরা অনেক কাহিনী আমরা শুনেছি। তবে আজকের কাহিনী একেবারেই ব্যতিক্রম কাহিনী। সানসিংতুন-এর নাম আগে সানসিং গ্রাম ছিল বলে শোনা যায়। তবে কেও কিন্তু ভাবতেও পারেননি, ‘ইয়ে’ নামে একজন কৃষক জমি চাষ করার সময় এমন বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করবেন। তারপর একটানা কয়েক দশকের গবেষণার পর প্রমাণিত হয়েছে, ৫ থেকে ৩ হাজার বছর আগে এখানে প্রাচীন ‘শু’ রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। সুউজ্জ্বল এই সভ্যতা এখানে ২০০০ বছর স্থায়ী ছিল। সানসিংতুন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ফলে ‘শু’ রাষ্ট্রের ইতিহাস আরও ২০০০ বছর এগিয়েছে।
এই আবিষ্কার চীনের সভ্যতার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। সানসিংতুন সভ্যতা আর ছুয়াংচিয়াং নদীর সভ্যতা ও হুয়াংহো নদীর সভ্যতার মতো সবই চীনের সভ্যতার মূল ভিত্তির উপর নির্ভর করে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সানসিং গ্রাম চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত। রাজধানী চেনতুং থেকে গাড়িতে যেতে হয়। সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। শোনা যায়, বর্তমানে এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। কাহিনীটি এমন- ৭৫ বছর আগেকার বিস্ময়কর আবিষ্কার এই গ্রামের শান্তভাব ভেঙে দিয়েছে। প্রায় ১০ বছর আগে এই স্থানে সানসিংতুন নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
সানসিংতুন জাদুঘর সূত্র বলেছে, উত্তর অক্ষাংশের ৩০ ডিগ্রিতে অবস্থিত এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। এই অক্ষাংশে আরও রয়েছে ছুমোলোংমা পর্বত, মায়া সভ্যতা, বারমুদা ত্রিকোণসহ আরও অনেক কিছু। এগুলোর অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এক রহস্য। সানসিংতুন হচ্ছে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি, আওতায় সবচেয়ে বড়, স্থায়ী সময় সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সবচেয়ে সাংস্কৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন এক বিস্ময়কর নগর।
অপর এক প্রত্নতত্ব থেকে জানা যায়, প্রায় ৩০০০ বছর আগে, এই প্রাচীন নগর হঠাৎ করেই বাতিল করা হয়। ফলে খুব উন্নত মানের সানসিংতুন সভ্যতা আকস্মিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। ৫ বছর আগে চেনতুং শহরের উপকণ্ঠে আবিষ্কৃত কিনশা ধ্বংসাবশেষ সেই গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতও দিয়েছে। এই দুটি পুরাকীর্তির বৈশিষ্ট্যে বহু মিল রয়েছে বলে শোনা যায়। যে কারণে কেও কেও বলেন, সানসিংতুন বর্তমান কিনশা ধ্বংসাবশেষের জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০০ বছর স্থায়ী একটি সুউজ্জ্বল প্রাচীন নগরকে বাতিল করার আসল কারণ কী ছিল তা কেও বুঝতে পারেননি। অনেকেই বলেন বন্যার জন্য। আবার কেও বলেন যুদ্ধের জন্য । আবার কেও বলেন, মহামারী রোগের কারণে। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড নেই। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে এক গোলক ধাঁধা রয়েছে। ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি হচ্ছে সানসিংতুনে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় জিনিস। এগুলো অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বলেও মনে হয়। বিশেষ করে কিছু ব্রোঞ্জ মূর্তির এশীয় ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে অনেক ভিন্নতা রয়েছে। তাদের রয়েছে বড় বড় চোখ, উঁচু উঁচু নাকের হাড়। সব মিলিয়ে একেবারেই ব্যতিক্রম। বিশেষ করে জাদুঘরের একটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি মুখোশের ব্যাখ্যা করা হয়েছে ঠিক এমনভাবে। বলা হচ্ছে এটি ‘শু’ রাষ্ট্রের প্রথম রাজার আসল মুখের মূর্তি। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে , এটা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় একটা ব্রোঞ্জ মুখোশ এবং রাষ্ট্রীয় মূল্যবান বস্তু। এই মুখোশের চোখ নাকি বেলুনাকার। কান খুব বড় এবং চূড়াযুক্ত। আরেকটি পুরাকীর্তি থোংটিয়ান গাছ ফরাসি পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ করেছে। প্রাচীনকালে চীনারা মনে করতো, গাছ হচ্ছে মহাশূন্যের অবতার। সূর্য, চাঁদ, তারা সবই গাছের ফল। ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি এই ৩.৬ মিটার উচু থোংটিয়ান গাছ বিশ্বের বিস্ময় বলা হয়ে থাকে। এই গাছ তৈরির প্রযুক্তিও নাকি খুব কঠিন। ইতিহাসের আলোকে যেটি পাওয়া যায় তা হলো, এমন ভাস্কর্য পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। এত বিশাল ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি এক বারে উৎপাদিত হওয়া নাকি কোনভাবেই সম্ভব নয়। শোনা যায়, আবিষ্কৃত আটটি ব্রোঞ্জ গাছের মধ্যে দুটি গাছ মেরামত করা হয়েছে। একটি গাছ মেরামত করতে তিন বছর সময় লাগে।
বলা যায়, ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি হচ্ছে সানসিংতুনে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির মধ্যে সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী পুরাকীর্তি। এই পুরাকীর্তিতে পুরোপুরি সেই যুগের চমৎকার শিল্প প্রযুক্তির মান প্রতিফলিত হয়েছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
রহস্যময় এই সানসিংতুন ধ্বংসাবশেষে বিপুল পরিমাণ হাতির দাঁত আর সামুদ্রিক খোলা আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা নাকি সানসিংতুনের আরেকটি রহস্য। কারণ বর্তমান সিচুয়ান প্রদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দেখে বোঝা যায়, সেখানে কোনোমতেই হাতি বেঁচে থাকার পরিবেশ নেই এবং সমুদ্র থেকেও বহু দূর এর অবস্থান। পণ্ডিতরা অবশ্য বলেন ভিন্ন কথা। তারা মনে করেন, হাতির দাঁত আর সামুদ্রিক খোলা দক্ষিণ সিল্ক রোডের মাধ্যমে এসে থাকতে পারে। প্রাচীন ‘শু’ রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক পথ সত্যি সত্যি খুব লম্বা, এমনকি পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলেই ইতিহাস ঘেটে দেখা গেছে। সানসিংতুন পুরাকীর্তি আফ্রিকা ছাড়াও অন্য আরও ৪টি মহাদেশে প্রদর্শিত হয়েছে। পর্যটকরা সানসিংতুনের প্রাচীন ও রহস্যময় সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে থাকেন। সানসিংতুনকে চাংচিয়াং নদী সভ্যতার উপরে একটি রাজমুকুট বলা হয়। আর তাই সময় পেলেই এখানে সানসিংতুন জাদুঘরে ছুটে আসেন সানসিংতুনের প্রাচীন ও রহস্যময় এই যাদুঘরে। আপনি কখনও যদি যাওয়ার সুযোগ পান তাহলে ঘুরে আসুন সানসিংতুনের প্রাচীন ও রহস্যময় এই যাদুঘরে। সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর অনলাইন।