দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দিয়ে মূলত কি সুবিধা পাওয়া যাবে এবং কি কি সুবিধা পাওয়া যাবে না সেই বিষয়ে আমরা অনেকেই জানি না। এই স্যাটেলাইটটি কোথায় স্থাপন করা হয়েছে এবং এটি কী পৃথিবীকে বেষ্টন করে ঘুড়বে নাকি স্থির থাকবে ?
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট কিছুদিন আগে মহাকাশে উড়ে গেল। এটা একটা জিওস্টেশনারি (ভূস্থির) স্যাটেলাইট। অনেকেই আবার স্যাটেলাইটকে স্পেইসক্রাফট” অথবা “বার্ড” বলে। সব স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারি নয়। যেসব স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারি, তাদের দুইটা বৈশিষ্ট্য থাকেঃ
১। তারা বিষুব রেখার ঠিক উপরে অবস্থান করে (এক ডিগ্রি কম/বেশি হতে পারে)
২। পৃথিবী যেমন নিজের অক্ষকে কেন্দ্র করে ২৪ ঘন্টায় একবার ঘুরে আসে, এই স্যাটেলাইটগুলিও পৃথিবীর অক্ষকে কেন্দ্র করে ২৪ ঘন্টায় একবার ঘুরে আসে।
এই দুই শর্তের ফলাফল—পৃথিবীর ঘোরার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই স্যাটেলাইটগুলি পৃথিবীপৃষ্টের একটা নির্দিষ্ট এলাকার ওপর থেকে যায়, অর্থাৎ জিও (পৃথিবী বা ভূ) + স্টেশনারি (স্থির) হয়ে যায়। নামে স্থির হলেও আসলে স্থির না; পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে বন্দুকের গুলির চাইতেও দ্রুত চলছে। তবে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে স্থির।
পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বিষুব রেখা বরাবর অসংখ্য লাইন টেনে যদি আকাশকে বৃদ্ধি করা হয়, জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলি সেই লাইনের উপরে থাকবে। কিন্তু এই দূরত্ব অসীম নয়; নিউটন আর কেপলারের কয়েকশ বছর আগে আবিষ্কার করা সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি, জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫,৮৫৩ কিলোমিটার দূরে থাকবে। এটাকে বলা হয় জিওস্টেশনারি অরবিট বা ভূস্থির কক্ষপথ। যেহেতু সায়েন্স ফিকশন লেখক আর্থার সি ক্লার্ক প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইটের এই ধারণা দিয়েছিলেন তাই এটাকে ক্লার্ক-এর নামে ক্লার্ক অরবিটও বলা হয়।
স্থায়ী কক্ষপথগুলোর একটা বিশেষ গুণ রয়েছে। এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে মহাকর্ষ আর ঘুর্ণন-এর গতিতে কাটাকাটি হয়ে যায় বলে সেই কক্ষপথের অবস্থানরত বস্তুটি অর্থ্যাৎ আমাদের পৃথিবী বা চাঁদ, যেটাই হোক না কেন, সেটা একই ভাবে ঘুরতে থাকে। স্যাটেলাইটগুলিও একই ভাবে ভূস্থির কক্ষপথেও ঘুরতে থাকে। কিন্তু কিভাবে সেটা পৃথিবীর সাথে তাল রাখে? প্রকৃতপক্ষে এত সুক্ষভাবে গতি রাখা অসম্ভব; তাই স্যাটেলাইটে গ্যাস থাকে যা উচ্চচাপে মাঝে মাঝে বের করে দিয়ে রকেটের মত অবস্থান ঠিক করে নেয়।
কেন এটা স্থির মনে হয়?
ধরুন, আপনি ৫ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকলেন, আর একই কেন্দ্র ধরে ৪০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের আরেকটা বৃত্ত আঁকলেন। আপনার বৃত্ত অঙ্কনের গতি যদি একই থাকে, তাহলে বড় বৃত্তটা আঁকতে ছোট বৃত্ত থেকে বেশি সময় লাগবে। কিন্তু যদি বড় বৃত্তটা আকার গতি বাড়িয়ে দেন, তাহলে কোন একটা নির্দিষ্ট গতিতে চললে দেখা যাবে, দুইটা বৃত্ত একই সময়ে শুরু এবং শেষ করা যাচ্ছে, অর্থাৎ ছোট বৃত্তের পেন্সিল আর বড় বৃত্তের পেন্সিল একই তালে চলছে। একইভাবে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট পৃথিবীর চাইতে দ্রুত গতিতে চলে বলে মনে হয় এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
কেন উড়ে চলে যাচ্ছে না বা পড়ে যাচ্ছে না:
প্লেন বা রকেট আকাশে উড়তে পারে জ্বালানী খরচ করে। কিন্তু স্যাটেলাইট কিভাবে ভেসে থাকে ইঞ্জিন না চালিয়েই? রকেটে করে প্রথমে স্যাটেলাইটটাকে সোজা উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর রকেটটা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘন্টায় প্রায় ১১,০০০ কিমি গতিতে চলতে শুরু করে এবং একসময় স্যাটেলাইটটাকে ছেডে দেয়। ছেড়ে দেয়া স্যাটেলাইটটাও গতিজড়তার কারণে একই গতিতে চলতে থাকে। এই গতির জন্য, যদিও স্যাটেলাইট পৃথিবীর আকর্ষনে নিচের দিকে নেমে আসে, কিন্তু এই নেমে আসার পরিমান, কক্ষপথের বক্রতার সমান। তাই পৃথিবী থেকে দূরত্ব সমান থেকে যায়। যদি এই গতি কম হতো, তাহলে এক সময় পড়ে যেত আর যদি বেশি হতো তাহলে উপবৃত্তাকার হয়ে যেত। এটা বুঝতে একটু অসুবিধা হয়, তাই একটা উদাহরণ- ধরুন ঢাকার রাস্তায় জলবদ্ধতার জন্য পানি দাঁড়িয়ে আছে। আপনি একটা ব্যাগ নিয়ে হাটছেন, ব্যাগটা পানি থেকে ৩৮ ইঞ্চি উপরে। হাটতে হাটতে কোথাও গর্তের কারণে পানি গভীর হলো, আপনি ব্যাগটা আরেকটু উপরে তুললেন, যাতে ব্যাগটা পানি থেকে সেই ৩৮ ইঞ্চি উপরেই থাকে। একইভাবে স্যাটেলাইটটাও সমান উচ্চতা বজায় রাখতে পারে।
তাহলে প্রায় ৪২,০০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্তের পরিধি প্রায় ২৬৪,০০০ কিলোমিটার (2πr)। এক কিলোমিটার দূরে দূরে রাখলেও ২৬৪,০০০ স্যাটেলাইটের জায়গা আছে, তাই না? কাগজে কলমে তাই, কিন্তু বাস্তবে না।
ফুটপ্রিন্ট/পদচিহ্ন কী?
দূর থেকে টর্চের আলো যেমন একটা আলোকিত বৃত্ত তৈরি করে, তেমনি স্যাটেলাইটের রেডিও সিগন্যাল শুধুমাত্র একটা এলাকা থেকে পাওয়া যায়। সেই এলাকাটাকে সেই স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্ট/পদচিহ্ন বলা হয়ে থাকে। রাতের আকাশে যেমন সূর্য পৃথিবীর আড়ালে পড়ে যায়, তেমনি অ্যামেরিকার আকাশে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য পৃথিবীর আড়ালে—বাংলাদেশ সেই স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্টে নাই এবং সেই স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশের কোন কাজ হবে না। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য এমন জায়গায় স্যাটেলাইট স্থাপন করা লাগবে, যাতে বাংলাদেশ তার ফুটপ্রিন্টে পড়ে। কোথায় স্যাটেলাইট বসবে, সেই জায়গাগুলিকে বলা হয় অরবিটাল স্লট (কক্ষঘর), এবং International Telecommunication Union (ITU) প্রতিটি দেশকে আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে স্লট দিয়ে থাকে। ক্যাচালটা এইখানেই—বাংলাদেশের উপরে বা আশেপাশের সব স্লট অন্য কিছু দেশ নিয়ে নিয়েছে (তালিকা নিচে)। বাংলাদেশ আগে চায় নাই, তাই পায় নাই। আবার অনেক দেশ নিজেদের স্যাটেলাইট দরকার নাই, তাই স্লট নিয়ে বিক্রি করেছে; যেমন টংগা নিজেদের পাঁচটা স্লট বছরে ২ মিলিয়ন ডলার দরে ১৯৮৮তে নিলাম করেছে।
দক্ষিণ গোলার্ধে সমুদ্রের উপরে অনেক জায়গা আছে, যেখানে কোন জমি নেই, কোন মানুষ থাকে না। সেই ফুটপ্রিন্টে স্লট পাওয়া যায়, কিন্ত সেটা নিয়ে কি হবে? ব্যাপারটা অনেকটা এরকম হয়ে গিয়েছে যে আপনি থাকেন ঢাকাতে, এবং চাইলেই আপনি ২০০০ মাইল দূরে সমুদ্রের দখল কিনতে পারেন । কিন্তু আপনার দরকার বাসা বানিয়ে থাকা; সমুদ্রের পানির দখল নিয়ে কি করবেন? সুতরাং আপনাকে এখন দাম দিয়ে অন্যের কাছ থেকে ঢাকাতেই জমি কেনা লাগবে। স্যাটেলাইটের জন্যও জরুরী আমাদের সেই ফুটপ্রিন্টে থাকা–সমুদ্রের পানি কিনলে চলবে না। অতএব বাংলাদেশ সেটাই করেছে, ১১৯.১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাতে একটা স্লট লিজ নিয়েছে ১৫ বছরের জন্য রাশিয়ানদের কাছ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলার দিয়ে, যেটার ফুটপ্রিন্টে বাংলাদেশ পড়ে।
বাসা বানাতে গেলে যেরকম প্রথমে জমি ঠিক করা লাগে, তার পর জমি বুঝে প্ল্যান, সেই প্ল্যান রাজউক থেকে পাশ করানো লাগে, স্যাটেলেইটের জন্যও তাই। প্রথমে জমি (স্লট) আশেপাশে কি স্যাটেলাইট আছে, তারা কোন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যাবহার করে, সেগুলির সাথে যাতে কোন সংঘর্ষ না হয়, সেটা হিসাব করে ITU ফ্রিকোয়েন্সি অনুমোদন দেয়। তারপর স্যাটেলাইট বানানো লাগে। বাংলাদেশ জমি পেয়েছে, প্ল্যান পাশ হয়েছে, এবং সব শেষে স্যাটেলাইট তৈরী হয়ে উড়ে গেল মহাকাশে।
উৎক্ষেপণের মোক্ষম সময়:
প্রথমবার উড়তে গিয়েও স্পেইস এক্স-এর ফ্যালকন-৯ রকেট শেষ মুহুর্তে এসে উৎক্ষেপন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে কেন আবার উৎক্ষেপন করা হলো না? কারণ এটা ঠিক কখন উৎক্ষেপন করলে সবচাইতে কম খরচে স্যাটেলাইট জায়গা মত পৌছান যাবে, সেটার একটা হিসাব। তাই যখনি একটু দেরি হয়েছে তাই একটু পর আবার উৎক্ষেপন না করে সেই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। চলন্ত কিছুর দিকে কখনো ঢিল মেরে দেখেছেন? আপনার ঢিল পৌছাতে পৌছাতে টার্গেট সরে যায়; তাই টার্গেট আর ঢিলের গতি হিসাব করে টার্গেটের সামনে ঢিল মারা লাগে। এখানেও তাই; স্লট কোথায় সেটা হিসাব করে উৎক্ষেপন করা লাগে কারন পৃথিবী ঘুরছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, উৎক্ষেপনস্থল যখন কক্ষপথ সমতলে থাকে তখন জ্বালানী কম লাগে। সেটা স্লটটা কোথায়, সেটার ওপরে নির্ভর করে। মহাকাশে কিছু পাঠানোর খরচ অনেক; প্রতি কেজি পাঠাতে খরচ প্রায় ২৫,০০০ ডলার বা ২০ লক্ষ টাকা। সুতরাং বাড়তি জ্বালানী পাঠাতেও অনেক খরচ। তাই খরচ কমানোর জন্য এই দুইটা হিসাব মাথায় রেখে দিনের যে সময়ে উৎক্ষেপন করলে সবচাইতে কম খরচ হবে সেটাকে লঞ্চ উইন্ডো বলা হয় ।
রাত জেগে বাংলাদেশের অনেকেই দেখলেন কিভাবে রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাকাশের দিকে ভেসে গেল আমাদের বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট। এই ধারাবর্ণনায় অনেকেই শুনেছেন, রকেটের স্টেইজ-২ ট্র্যান্সফার_অরবিট-এ (স্থানান্তর কক্ষপথ) পৌছে দিল। ধরুন, প্লেনে করে বিদেশ থেকে দেশের এয়ারপোর্টে নামলেন। এবার বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়িতে করে যেতে হবে। ট্র্যান্সফার অরবিট এরকম মধ্যবর্তি একটা স্থান, যেখানে রকেট থেকে স্যাটেলাইট আলাদা হয়ে যায়। এর পর স্যাটেলাইট নিজের জ্বালানী ব্যবহার করে তার নিজস্ব স্লটে পৌছে যাবে। এই কাজটা করবে থালিস-এর প্রকৌশলীরা; স্পেইস-এক্স এর এখানে আর কোন ভূমিকা নেই। কিছুদিন পরীক্ষা-নিরিক্ষার পরে শুরু হবে এর বানিজ্যিক ব্যাবহার। দেশের দুটা উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র অন্যের স্যাটেলাইটের বদলে আমাদের নিজেদের স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ রাখবে।
১৫ বছর পরে কি হবে?
স্যাটেলাইট এমনিতেই এক জায়গায় থাকে না, আস্তে আস্তে সরতে থাকে। সেটাকে মাঝে মাঝে আবার ঠিক জায়গায় আনা লাগে। যখন আয়ু শেষ হয়ে যাবে, কিছু না করলে সেটা এমনিতেই নিচে নামতে নামতে এক সময় বায়ুমন্ডলে ঢুকবে এবং পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু যেহেতু স্লটের দাম আছে, হয়তো এভাবে নিজে থেকে নামতে না দিয়ে সেটাকে ধাক্কা দিয়ে (জ্বালানী পুড়িয়ে) নামানো হবে অথবা ধাক্কা দিয়ে আরো ২০০ কিমি উপরে তুলে দেয়া হয় যেখানে সেই মৃত স্যাটেলাইট ঘুরতেই থাকে। আর পরবর্তি স্যাটেলাইট একই স্লট নিতে পারে বেশি অপেক্ষা না করেই। মাত্র ১৫ বছর কেন?
সব ইলেক্ট্রনিকেরস মতই, স্যাটেলাইটের ক্যাপাসিটি দিন দিন বাড়ছে আর দাম কমছে। ৫০ বছর টিকবে এমন স্যাটেলাইট বানানো সম্ভব, কিন্তু সেটা ১০-১৫ বছর পরে আর নতুন স্যাটেলাইটের সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। তাই এগুলি এভাবেই ডিজাইন করা হয়।
এই স্যাটেলাইট দিয়ে ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাবে?
রেডিও দিয়ে যেমন টিভি দেখা যায় না, তেমনি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট দিয়ে আবহাওয়া দেখা যায় না। এই স্যাটেলাইটে আবহাওয়া পর্যবেক্ষনের কোন যন্ত্র নেই। তাহলে এটা দিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাবে না।