দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মুন্সীগঞ্জ সদরের রঘুরামপুরে বৌদ্ধবিহার এবং টঙ্গিবাড়ীর নাটেশ্বর বৌদ্ধ নগরী আবিস্কারের পর এবার রামপালের বল্লালবাড়িতে আবিষ্কৃত হয়েছে সেন আমলের রাজবাড়ি।
ধারণা করা হচ্ছে যে, এই রাজবাড়িটিতে রাজা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ এবং মন্দির রয়েছে। দু’দিনের পরীক্ষামূলক খননেই মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা ৮শ’ বছরের পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন খননকারীরা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মুন্সীগঞ্জ সদরের রামপাল ইউনিয়নের বল্লালবাড়ী এলাকাটি বাংলার সেন রাজাদের রাজধানী ‘বিক্রমপুর’ হিসেবে অধিক পরিচিত থাকলেও সেখানে রাজবাড়ির কোনো চিহ্নই এতোদিন দৃশ্যমান ছিল না। দখল হয়ে যাওয়া এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটিতে চারদিকে পরিখাবেষ্টিত এমন বিশাল বাড়িটি আবিষ্কারের জন্য ইতিপূর্বে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননই করা হয়নি। ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উদ্ধারে ২০১১ সাল হতে প্রত্নতত্ত্ব জরিপ এবং খনন কাজ শুরু করা হয়। এতে রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হয় হাজার বছরের বৌদ্ধবিহার এবং টঙ্গিবাড়ীর নাটেশ্বরের বৌদ্ধমন্দির। এবার একই ইউনিয়নের বল্লালবাড়ি এলাকায় আবিষ্কৃত হলো সেন আমলের এই রাজবাড়ি।
খনন কাজের তত্ত্বাবধানে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বল্লালবাড়িতে খনন কাজে পাওয়া পাথরগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কোনো স্থাপত্যের ভাঙা টুকরোও হতে পারে। বড় আকারের খনন কাজ করলে আরও অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। তাঁর ধারণা মতে, খনন কাজ শতভাগ সম্পন্ন হলে পুরো একটি রাজধানীর চিত্রই ফুটে উঠতে পারে।
অধ্যাপক শাহ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আরও জানান, গত ২১ জানুয়ারি হতে দুই দিনের পরীক্ষামূলক খনন কাজ করা হয়েছে। চীন এবং বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক দল যৌথভাবে এই কাজে অংশ নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বল্লালবাড়ি খননের পর যে স্তর পাওয়া গেছে, তাতে এখানে রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদ ছিল বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বাড়িটির চারদিকে পরিখা রয়েছে। মূলত প্রাসাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কৃত্রিমভাবে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে পরিখার ওপর এখন রাস্তা এবং ভবন রয়েছে। রামপাল কলেজের পেছন হতে পরিখাটি স্পষ্ট দেখা যায় বলে তিনি জানিয়েছেন। এই পরিখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, প্রাসাদটি একটি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই ছিল। এই জায়গাটি বর্তমানে ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে মালিকদের অনুমতি নিয়েই খনন কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. নূহ-উল-আলম লেনিন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বল্লালবাড়িতে পরীক্ষামূলক খনন শুরু করা হয়েছে। ২১ জানুয়ারি মাত্র ৯ বর্গমিটার খননেই বেরিয়ে এসেছে প্রাচীন বসতির গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য স্থাপত্যের চিহ্নরেখা। প্রথম দিনই উন্মোচিত হয় সেন রাজবাড়ির প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনাময় নিদর্শন। লেনিন আরও জানান, খননকালে প্রাচীন ইটের গাঁথুনি, মৃৎপাত্র ও চারকোলসহ আরও বেশ কিছু জিনিসও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রত্ননিদর্শনের বয়স কিংবা নির্মাণকাল নির্ধারণ করার জন্য চারকোলের কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এই স্থান থেকে পাওয়া চারকোল দিয়েও তাই সহজেই এটার বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। নূহ-উল-আলম লেনিন বলেছেন, এই খনন কাজের শুরুতেই প্রায় ৮শ’ বছরের বাঙালির ইতিহাসের একটি চমকপ্রদ অধ্যায় আবিষ্কারের সূচনা হয়েছে। সেন রাজবাড়ি আবিস্কারের মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে আরও একটি অধ্যায় যুক্ত হতে চলেছে।
গবেষকদের ধারণা মতে, এখানে বর্গাকৃতির একটি দূর্গও ছিল। যতোটুকু খনন করা হয়েছে, তাতেই স্থাপত্যের নমুনা বেরিয়ে এসেছে। এর সঙ্গে জরিপ মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে যে, সেন রাজার বাড়িতে একটি প্রাচীর ঘেরা দূর্গের মতো প্রাসাদ এবং মন্দিরও ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানান, সংগ্রহকৃত চারকোলটি আমেরিকান ল্যাবরেটরি ‘বেটা’তে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। সেখানে কার্বন পরীক্ষা শেষে সংগ্রহ করা নমূনা কত বছর পূর্বের সেটি জানা যাবে। ইতিহাসে বল্লাল সেনের একটি সময়ও রয়েছে। তাই দুই সময় মিলিয়ে অসাধারণ একটি তথ্য ইতিহাসে যোগ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।