দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আজ এমন এক বাংলাদেশীর কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে যিনি মাত্র একটি ট্রাক থেকে ১২শ বাসের মালিক বনে গেছেন!
কালে কালে বাংলাদেশে পরিবহন খাতের বিকাশ হয়েছে তার হাত ধরেই। দেশের বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করে চলেছে তার প্রতিষ্ঠিত ১২শ’ বাস। পরিবহন খাতের সংগ্রামী ও সফল এই মানুষটি হলেন হানিফ এন্টারপ্রাইজের স্বপ্নদ্রষ্টা জয়নাল আবেদীন।
জেনে অবাক হতে হয়, এই পরিবহন সেক্টরে আসার শুরুতে মাত্র একটি ট্রাক ছিল তার। নিরলস শ্রম ও কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তিনিই হয়ে উঠেছেন দেশের ‘ফাদার অব কোচ ট্রান্সপোর্টেশন’।
এলাকার মানুষজন তাকে জয়না মহাজন নামেই ডাকেন। জয়নাল আবেদীনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজধাণী ঢাকার খুব কাছেই সাভারে। মাত্র একটি ট্রাক নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে শুরু হয় কোচ ব্যবসা। গড়ে তোলেন পরিবহন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যার নাম ‘হানিফ এন্টারপ্রাইজ’। ছোট ছেলে হানিফের নামেই গড়ে তুলেছিলেন হানিফ এন্টারপ্রাইজ নামে এই প্রতিষ্ঠানটি। তারপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি।
পেট্রোল পাম্প, সিএনজি স্টেশন, কোল্ডস্টোরেজ, ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারিং, পানীয় ও প্রকাশনা ব্যবসাও গড়ে তুলেছেন এই স্বপ্নবাজ ব্যক্তিত্ব জয়নাল আবেদীন। পরবর্তীতে যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই যেনো ফলিয়েছেন সোনা!
জয়নাল আবেদীনের বাবা হাজী মো. আজিম উদ্দিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টানা দুই যুগ ধরে আমিনবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠলেও প্রথম থেকেই জয়নাল আবেদীন সব সময় রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে চলেছেন। মিডিয়া তাকে কখনও আকর্ষণ করে না।
জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিনীতভাবে তিনি জানিয়ে দেন, কোনো সাক্ষাৎকার কিংবা ছবি নেওয়া যাবে না। তবে পাঠকদের আগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই কিছুটা নমনীয় হয়েছিলেন তিনি। বলতে থাকেন তার সাফল্যের সেই দিনগুলোর অজানা গল্পগুলো।
জয়নাল আবেদীন বলেছেন, আমার জন্ম সাভারের আমিনবাজারের হিজলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম ব্যবসায়ী পরিবারেই। ৫ ভাইয়ের মধ্যে আমি ছিলাম ৫ম। বাবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকার সময় আমদানি রফতানির ব্যবসাও করতেন। বিশেষ করে তিনি ধান-চাল ও চামড়ার সফল একজন ব্যবসায়ী ছিলেন।
আমার বাবাই ছিলেন প্রথম ব্যবসায়ী যিনি সেই সময় প্রথম করাচি, বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) এবং বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) সঙ্গে জলপথে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই সুবাদে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং রাজনীতিবিদ আসতেন আমাদের বাড়িতে। সেই সময় আমার বড় ভাই সালাউদ্দিন ডাক্তারি পড়ছিলেন।
আমি তখন ভর্তি হই আমিনবাজার মিরপুর মফিদ-ই-আম জুনিয়র মাদ্রাসাতে। সেখান থেকেই বাবা আমাকে ভর্তি করেন মিরপুর সিদ্ধান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেই সময় আমি অত্যন্ত দূরন্ত (চঞ্চল) ছিলাম। লেখাপড়ায় মন ছিল না আমার। সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরতাম।
ইতিমধ্যে বাবা বড় ভাইকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মিরপুরের হাজী নুরুল ইসলামের মেয়ে মমতাজ বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন। তবে বড় ভাই তখন বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেই বসানো হলো সেই বিয়ের পিঁড়িতে। তখন আমার বয়স হবে মাত্র ১৪ বছর। মমতাজ বেগমের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়ায় ব্যবসা শুরু করলাম আমি। বাবার টাকায় আমি শুরু করলাম ধান-চালের ব্যবসা। সেই সময় এতো পরিবহন তো ছিলই না, এমনকি দূরপাল্লার রাস্তাও ছিল খুবই কম। যাতায়াতের প্রধান মাধ্যমই ছিল ট্রেন, না হলে নৌপথ।
ধান-চালের ব্যবসায় কমলাপুর হতে ট্রেনে সান্তাহার-সেখান থেকে বাসে চেপে নওগাঁ-তারপর টমটম করে মহাদেবপুর-সেখান থেকে পায়ে হেটেঁ চলে যেতাম মহিষবাথান নামের স্থানে।
সেখানের মানুষ আমার কাছে ৩ হাজার টাকা দেখে অবাক! তারা ভাবছিল এতো কম বয়সী ছেলের হাতে এতো টাকা! এমনকি আমাকে চাল ব্যবসায়ী মনে করাটাও বোকামি মনে করছিল অনেকেই।
হঠাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানে চালে আকাল লাগে। চালের সরবরাহ কম, মূল্য অনেক বেশি। তাই চাল কিনতে প্লেনে চেপে আমি যশোর গেলাম। তখন ভাড়া ছিলো মাত্র ২৭ টাকা। সঙ্গে ছিল আমার গোমস্তা। সেই সময়ই আমি একাই আড়াইশ মণ চাল কিনলাম। এবার আমার ফেরার পালা।
নানা ঘাট হয়ে আমাদের চাল বোঝাই নৌকা যখন মুন্সীগঞ্জের খুব কাছে পদ্মায় ভাসছিল ঠিক তখন প্রচণ্ড ঝড়ে নৌকা ডুবে গেলো। সে যাত্রায় মাঝিদের সহায়তায় প্রাণে রক্ষা পাই আমরা। যতোদূর মনে পড়ে, ওই দুর্ঘটনায় হাতের মুঠোয় আকঁড়ে রাখা ৫০ টাকায় ছিল আমার বাড়ি ফেরার শেষ সম্বল। বাড়ি ফিরে এসে ধান-চালের ব্যবসা বাদ দিলাম।
তারপর পরিবারের ৫ ভাই একসঙ্গে হজ্ব করতে সৌদি আরবে গেলাম। এই ঘটনা এলাকায় তো বটেই, ভরতবর্ষেও তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। তৎকালীন লর্ড এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে আমাদের পরিবারকে ঐতিহ্যবাহী পরিবার হিসেবে অাখ্যা দেন। তখন থেকেই এলাকায় আমাদের বাড়ির নাম হলো হাজী বাড়ি। আমরা কোলকাতা বন্দর থেকে জলপথে জাহাজে চেপে সৌদি বন্দরে পৌঁছালাম। সেখান থেকেই উটের পিঠে চড়ে গেলাম মক্কা-মদিনায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, দেশ পুনর্গঠনে ডাক পড়লো। মানিক মিয়া এভিনিউ, সংসদ ভবন এলাকাতো তখন বোরো ক্ষেত। ওই ক্ষেতেই সাব কন্ট্রাক্টে শুরু করলাম মাটি ফেলার কাজ।
মাত্র ১৪ হাজার টাকায় ৩ টনি একটি পেট্রোল ট্রাক কিনলাম। সেখান থেকেই আমার শুরু। সেইসঙ্গে কয়েকটি ট্রাক ভাড়াও নিলাম। পরে ট্রাকটি বিক্রি করে বেডফোর্ডের ৫ টনি ডিজেল ট্রাক কিনলাম।
সেই একই সময় কাজ পেলাম ফেনীর মাতামুহুরী নদীর বাঁধ নির্মাণের। সেখানেও সাব কন্ট্রাক্ট করলাম। মাটি ফেলার কাজের জন্যে ঠিকাদার আমাকে অগ্রিম ১০ লাখ টাকা দিলেন। তা দিয়েই কিনলাম দুটি হিনো কোচ।
ছোট ছেলে হানিফের নামে যাত্রা শুরু হলো ‘হানিফ এন্টাপ্রাইজ’। প্রথমে ঢাকা-বগুড়া রুট। পরবর্তীতে একটির সাফল্য ধরে আরও একটি একটি করে রুট বাড়তে থাকলো হানিফ এন্টারপ্রাইজ এর। এভাবেই গত চার দশকে আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছে ১২শ’ বাস।
রাজনীতিতে না আসার কারণ হিসেবে জয়নাল আবেদীন বললেন, হয়তো আমি আরও বহুদূর যেতাম! তারপর নিজের আবেগ থামিয়ে সতর্ক হয়ে কথায় ফিরিয়ে আনলেন নিজেকে।
বর্তমানে হানিফ এন্টারপ্রাইজে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সততা, বিশ্বস্ততা ও নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জয়নাল আবেদীন। আজ অনেকেই তার দুই ছেলেকেও চেনেন। এখানেই তার খুব আনন্দ। তথ্যসূত্র: www.deshebideshe.com