খাদ্যে যখন স্বাস্থ্যনাশ: অতিরিক্ত শর্করাও দেহকে মোটা করতে পারে

দি ঢাকা টাইমস্‌ ডেস্ক ॥ শুধু খাদ্য খেলেই হবে না। সে খাদ্য হতে হবে নিয়ম মাফিক। তা নাহলে সে খাদ্যও আপনার স্বাস্থ্যনাশের কারণ হতে পারে।

আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় নানা ধরনের উপাদেয় ও বিভিন্ন স্বাদের খাবারের সমন্বয় দেখা যায়। এ খাবার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা ভেবে দেখার সময়ও অনেক সময় আমরা করতে পারি না। কম পরিশ্রমে সহজে তৈরি করা যায় এমন খাবারকে আমাদের প্রাধান্য দেয়া উচিত। প্রাচ্যের দেশগুলোর মতোই আমাদের এই অনুন্নত দেশেও দিন দিন অতিরিক্ত মোটা বা অতিউচ্চ ওজনসম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখনই আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।

তৈলাক্ত খাবার বাদ দিয়ে আমরা অনেক সময় শর্করা-জাতীয় খাবারকে প্রাধান্য দিচ্ছি। মনে করছি যে তেল তো কম খাওয়া হচ্ছে তবে ওজন কেন বাড়ছে? অনেকে আবার বলেন আমি খাবারে একেবারেই কম তেল দিই, তবুও দিন দিন ওজন বাড়ছে। দেখা গেছে অন্য খাবারগুলোর মধ্যে শর্করা-জাতীয় খাবার খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া হচ্ছে। অথবা যা খাওয়া হচ্ছে সে পরিমাণ পরিশ্রম করা হচ্ছে না। তাই আমরা প্রতিদিন কতটুকু খাব, কী পরিমাণ খাব সে সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। অনেকে ভাতের বিকল্প মুড়ি, চিঁড়া, খই বা রুটি খাচ্ছেন। কিন্তু এই খাবারগুলোতে প্রায় একই পরিমাণ এনার্জি বা শক্তি থাকে যা আমাদের ওজন দ্রুত বাড়াতে সাহায্য করে। তাই খাবারের তালিকায় এমন সব খাদ্য উপাদানের ব্যবস্থা করতে হবে যেগুলো খেলে আমাদের শর্করার চাহিদা পূরণ হবে, সঙ্গে সঙ্গে ওজন বৃদ্ধি হ্রাস হবে।

সেগুলো হচ্ছে লাল চালের ভাত, ভূষিসমেত আটার রুটি, ইসবগুলের ভূষি, বিভিন্ন ধরনের শাক, বরবটি, ডাঁটা, শজনে, সপ্রাউট ইত্যাদি। এগুলো আমাদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত করতে হবে। এতে আমরা সুস্থ থাকতে পারব। আরেকটা কথা, খাবারে উদ্ভিজ তেল অর্থাৎ ভেজিটেবল অয়েল সীমিত পরিমাণ খাওয়া যেতে পারে। অনেক সময় দেখা গেছে, তেল খাওয়া বন্ধ করে দেয়ার ফলে চামড়া শুষ্ক ও খসখসে হয়ে পড়ছে, চুল পড়ে যাচ্ছে, চেহারার উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই এসব থেকে আমরা সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেল, সামুদ্রিক মাছ, কর্ডলিভার অয়েল ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারি। শুধু খাবারের পরিমাণ কমালেই হবে না, সেইসঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমও করতে হবে। দৈনিক আধ ঘণ্টা করে হাঁটতে হবে। এই হাঁটা আবার যেমন তেমন হাঁটা হলে চলবে না। প্রতি সেকেন্ডে দুই কদম ফেলতে হবে, এমনভাবে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। প্রথমেই এভাবে সম্ভব নয়, তাই দশ মিনিট করে শুরু করতে হবে। এভাবে সব দিক থেকে সতর্ক থাকলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

আমরা প্রতিদিন ৩-৪ বার প্রধান খাবার যেমন ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, পালংশাক, সবজি খাই এবং তার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাক্স যেমন, চা-বিস্কুট, ট্যাং এবং উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন খাবার যেমন স্যান্ডউইচ, বার্গার, আইসক্রিম, কোমল পানীয়, সিঙ্গারা, সমুচা, পেটিস এবং মুখরোচক খাবার খাই। রাস্তার ধারে পাওয়া যায় যেমন পিঁয়াজু, বেগুনি, চটপটি, লাচ্ছি, মুড়ি ও চানাচুর মাখা এবং বিভিন্ন ধরনের পানি গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু এগুলো কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত এবং কোন কোন সময় এ খাদ্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া যেমন- পেটেরপীড়া, ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি এবং বিষক্রিয়া হয়ে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। এর মধ্যে ২-৩টি প্রধান বিষক্রিয়ার বর্ণনা করা হল-

খাদ্যে অসহনীয়তা বা ফুড ইনটলারেন্স

এটা খাদ্যের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা ইমিউন রিলেটেড নয় এবং বিভিন্ন ওষুধজনিত কারণে যেমন হিস্টামিন, টাইরামিন বা মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট, বিপাকীয় বা মেটাবলিক যেমন, ল্যাকটোজ স্বল্পতা বা অন্যান্য মেকানিজম যেমন খাদ্যে উপস্থিত বিষ যা টকসিন একং খাদ্যে মেশানো বিভিন্ন কেমিক্যালস-এর কারণে হয়।

Related Post

ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সজনিত ডায়রিয়া- মায়ের দুধ বা টিনজাত দুধে ল্যাকটোজ বেশি থাকলে বা শরীরে এনজাইম কম হওয়ার কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত: মায়ের দুধের মধ্যে ২০০ মিলিমোল/লিটার ল্যাকটোজ থাকে যা হজমের পর গ্লুকোজ এবং গ্যালাকটোজে রূপান্তরিত হয় অন্ত্রের ব্রাশ বর্ডারে উপস্থিত একটি এনজাইমের কারণে। বেশিরভাগ ল্যাকটোজ রূপান্তর এনজাইম স্বল্পতার কারণে যে ডায়রিয়া হয় তা কোন লক্ষণ প্রকাশ করে না। কারও কারও ক্ষেত্রে পেট মোচড়ানো, ব্যথা, পেট ফুলে বা ফেঁপে যাওয়া, পেটে বাতাস বেশি তৈরি হওয়া ও বাতাস বের হওয়া, পেটে গড় গড় শব্দ হওয়া এবং বারবার পায়খানা হয় দুধ বা দুধজাতীয় খাবার খাওয়ার পর। পায়খানা পরীক্ষা করে রিডিউসিং সাবস্টেন্স উপস্থিত থাকলে এ রোগ নির্ণীত হয় এবং ল্যাকটোজ কম বা ল্যাকটোজ মুক্ত খাবার দিয়ে এর চিকিৎসা করা হয়।

অন্যান্য সুগারের কারণে ডায়রিয়া

অহজমযোগ্য শর্করা বা সর্বিটলের কারণে অসমোটিক ডায়রিয়া হতে পারে যা চিনির পরিবর্তে ব্যবহূত সুইটনারের কারণে হয়ে থাকে।

ফ্রুকটোজ বেশি গ্রহণের কারণে (বেশি করে ফলের জুস গ্রহণ করলে) ডায়রিয়া হতে পারে।
এগুলো পরিহার করলে এসব ডায়রিয়া থেকে মুক্ত থাকা যাবে।

খাদ্যে অ্যালার্জি

খাদ্যে অ্যালার্জি ইমিউন মেডিয়েটেড রোগ। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইমিউনোগ্লোবিউলিন আইজিই এন্টিবডির কারণে হয়ে থাকে এবং টাইপ-১ হাইপার সেনসিটিডিটি প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশ পায়। শতকরা ২০ ভাগ লোক বিভিন্ন খাদ্যের বিপরীতে অ্যালার্জিতে ভোগেন। সবচেয়ে বেশি খাদ্যে অ্যালার্জি রয়েছে এমন সব খাবার হল- চিংড়ি মাছ, গরুর মাংস, বেগুন, দুধ ও দুধজাত খাবার, ডিম, সয়া, শেলযুক্ত মাছ। এসব খাদ্য গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে বা কিছুক্ষণের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তির সারা শরীরের বা স্থানীয়ভাবে লাল র‌্যাশ, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট এবং কোন কোন সময় মৃত্যু হতে পারে। কারও কারও ফ্রেশ ফ্রুট জুস (যার মধ্যে বেনজয়িক এসিড থাকে) গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে চুলকানি, র‌্যাশ, ঠোঁট এবং গলার মধ্যে ফুলে যায়। ফুড অ্যালার্জির জন্য রোগ নির্ণয় খুব কঠিন তবে চামড়ার অ্যালার্জির টেস্ট, সিরাম ওমঊ এন্টিবডি নির্ণয় রক্তে ইউসিনোফিলের পরিমাণ বাড়া এবং কোন কোন খাবার খেলে এগুলো হয় তা জানলে এ রোগ নির্ণয় সম্ভব। এসব রোগীর উপরের লক্ষণগুলো ছাড়াও ডায়রিয়া, বমি ভাব, বমি, বুক ধড়ফড় করা এবং নিঃশ্বাসের কষ্টও হতে পারে। যেসব খাবার খেলে ফুড অ্যালার্জি হয় সেগুলো পরিত্যাগ করা, ফুড অ্যালার্জি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো এন্টিহিস্টামিন এবং কর্টিকোস্টেরয়েড গ্রহণ করা, জীবন সংকটাপন্ন হলে আইসিইউতে স্থানান্তর করে চিকিৎসা করতে হবে।

ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়া

বহুদিন ধরে সংরক্ষিত খাবার পরবর্তী সময়ে গ্রহণ করলে এ ধরনের খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। সাধারণত ক্লস্ট্রিডিয়াম বুটোলিনাম নামক স্পোরযুক্ত ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই বিষক্রিয়া হয়। সাধারণত টিনজাত মাংস, সালমোন মাছ, সবজি, মধু এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়ে বুটোলিজম নামে মারাত্মক বিষক্রিয়া তৈরি করে। এর ফলে আক্রান্ত শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক পেটেরপীড়া, উভয় পাশের ক্রানিয়াল নিউরোপ্যাথি এবং সঙ্গে আস্তে আস্তে নামতে থাকা হাত পায়ের দুর্বলতা, ঢোক গিলতে বা খেতে কষ্ট হওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা বা দুই প্রতিচ্ছবি দেখা এবং শ্বাসকষ্ট বা শ্বসন প্রণালী অবশ হয়ে যাওয়া। সাধারণত জ্বর থাকে না। রক্তচাপ স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক বা কম হূদস্পন্দন বা পালস থাকে। এসিসটেড ভেল্টিলেশন জেনারেল সাপোর্টিভ ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে পলিভালেন্ট এন্টিটকসিন দিলে রোগী ভালো হয়ে যায়। কালচার করে ক্লস্ট্রিয়াম বুটোলিনাম এ রোগ শনাক্তকরণ করা হয়। সঙ্গে রক্তের টিসি, ডিসি পরীক্ষা করতে হয়। কোন কোন সময় যে ব্যক্তি খাবার কাটছে, রান্না করছে তার হাতে উপস্থিত বিভিন্ন জীবাণু বিশেষত: ই-কোলাইয়ের কারণে খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে এবং সঠিক এবং দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ না করলে মৃত্যু মুখে পতিত হতে পারে। কিছুদিন আগে জার্মানি ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে ই-কোলাইজনিত খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে ৩০-৩৫ জন লোকের মৃত্যু হয়েছে। এটা হয়েছিল শসা যা ই-কোলাই দিয়ে সংক্রমিত হয়েছিল খাওয়ার কারণে। এজন্য কাঁচা সালাদ জাতীয় ফলমূল সব সময়ই ভালো করে ধুয়ে তারপর খেতে হয়। এই ই-কোলাই বায়োটেরোরিজমের একটি অস্ত্র। এজন্য পৃথিবীর উন্নত দেশে এর সংক্রমণের বিপরীতে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সবসময়ই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

একথা সত্য যে, খাবার ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। কিন্তু খাবার গ্রহণের আগে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ধুয়ে কেটে রান্না করে না খেলে খাদ্যে বিষক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এছাড়াও যেসব খাবারে অ্যালার্জি হয় যেমন চিংড়ি মাছ, বেগুন, গরুর মাংস, ডিম, দুধ ও দুধজাত দ্রব্য, শৈল মাছ এগুলো পরিত্যাগ করতে হবে। খাদ্যে বিভিন্ন সুগারের উপস্থিতির বা এনজাইমের অভাবে ডায়রিয়া ডিসেন্ট্রি হতে পারে এগুলো পরিহার করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল বেশি দিন ধরে সংরক্ষিত টিনজাত মাছ, মাংস, সবজি না খাওয়াই ভালো। খেলে খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। অর্থাৎ খাবার সম্পর্কে একটু সচেতন হলে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে খাদ্যে বিষক্রিয়া এবং অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকা যাবে।

# অধ্যাপক ডা. মোঃ তাহমিনুর রহমান সজল
বিভাগীয় প্রধান (প্যাথলজি), আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

This post was last modified on জুন ১৩, ২০২২ 11:18 পূর্বাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার

Recent Posts

সঠিক নিয়ম মানলে আম খেয়ে পেটের কোনো সমস্যা হবে না

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ পরিমাণে একটু বেশি আম খেলেই গ্যাসের মতো সমস্যা হয় অনেকের।…

% দিন আগে

বাংলা ভাষার প্রথম স্মার্টওয়াচ এবার বাজারে এলো

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ। দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আজওয়া টেকের…

% দিন আগে

আবারও অনিরুদ্ধর সিনেমায় অভিনয় করবেন জয়া

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বলিউডের বহুল আলোচিত সিনেমা ‘পিংক’ এর নির্মাতা অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর…

% দিন আগে

হামাসকে সাত দিনের সময় দিলো ইসরায়েল!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ জিম্মি চুক্তিতে রাজি হতে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে মাত্র সাত…

% দিন আগে

আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ কিন্তু নয়: মরুভূমিতে খুঁজতে হবে এক সাহেবী কেতার ল্যাম্পশড!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ এবারের ছবিটি একটু ভিন্ন ধরনের এই ছবির ভিতরে লুকিয়ে চুরিয়ে…

% দিন আগে

কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শুভ সকাল। শনিবার, ৪ মে ২০২৪ খৃস্টাব্দ, ২১ বৈশাখ ১৪৩১…

% দিন আগে