দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক সদ্য প্রয়াত ডেভিড ফ্রস্টের নির্মিত তথ্যচিত্র প্রচার করেছে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আল-জাজিরা।
জানা যায়, ফ্রস্ট জীবিত থাকার সময় তথ্যচিত্রের কাজ শেষ করেছেন। তথ্যচিত্রের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ডেভিড ফ্রস্ট হাইকমিশনার ও তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের এ তথ্যচিত্রের শুরুতেই বলা হয়- ‘শেখ হাসিনা, প্রাইমমিনিস্টার অব বাংলাদেশ। ওয়ান অব দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল উইমেন ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড’। তথ্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর কিছু দুর্লভ ফুটেজ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে বিমান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখার একটি ফুটেজও আছে। ফ্রস্টই প্রথম বিদেশি সাংবাদিক, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎকার নেন। বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের অংশও প্রচার করা হয়। ১৯৭২ থেকে শুরু করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ এমন সব ভিডিও ফুটেজ রয়েছে এই ডকুমেন্টরীতে।
ওই সাক্ষাৎাকারে শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী সম্পর্কে বলেছেন, আমার পিতা নিজের কথা বা নিজের পরিবারের কথা কখনও ভাবেননি। তিনি দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন। জীবন দিয়ে তার প্রমাণও রেখেছেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সম্পর্কে ডেভিড ফস্ট্রের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর আর আমার মধ্যে শুধু কিছু নীতিগত রাজনৈতিক পার্থক্য রয়েছে, তাঁর (খালেদা জিয়া) সঙ্গে আমার কোন বিদ্বেষ নেই। আসলে মানুষ আমাদের দুজনকেই হিংসা করে। আর তাই আমাদের দুজনকে এমন ভাবে।
১৯৭২ সালের পর সর্বশেষ চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েছিলেন ফ্রস্ট। তথ্যচিত্রের তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ওই সময় হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়াতেও যান ফ্রস্ট। ওই সময় বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ ৪১ বছর পর আবার বাংলাদেশে আসলাম।’ ওই সময় তিনি শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে আবারও সফরে আসবেন বাংলাদেশে। কিন্তু, অনিবার্য মৃত্যু তাকে সেই সুযোগ আর দেয়নি। ৭৪ বছর বয়সী প্রখ্যাত ব্রিটিশ টেলিভিশন উপস্থাপক, সাংবাদিক, ভাষ্যকার ও লেখক স্যার ডেভিড ফ্রস্ট হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৩১ আগস্ট মারা যান। ব্রিটিশ প্রমোদতরি এমএস কুইন এলিজাবেথে বক্তব্য দেওয়ার সময় হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। ‘দি ফ্রস্ট রিপোর্ট’, ‘দ্যাট ওয়াজ দ্য উইক দ্যাট ওয়াজ’ প্রভৃতি তার উপস্থাপিত বিখ্যাত টেলিভিশন শোগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা একসময় সারা পৃথিবীর টেলিভিশন দর্শকদের আলোড়িত করেছিল। তবে দীর্ঘ টেলিভিশন উপস্থাপনার ক্যারিয়ারে তিনি মূলত বিখ্যাত হন পৃথিবীর বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও সাক্ষাৎকার নেন তিনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছিল ডেভিড ফ্রস্টের নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারেই এদেশবাসীর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু। সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হওয়ার বিষয়টি। সাক্ষাৎকার নিতে কখনও বঙ্গবন্ধুর অফিসে, কখনও তার বিখ্যাত সেই ছোট্ট নীল সরকারি গাড়িতে, কখনও ৩২ নম্বরে বাড়ির শোবার ঘরে, বারান্দায় বা লনে গেছেন ফ্রস্ট। বঙ্গবন্ধুও ব্যস্ততার মধ্যে ডেভিড ফ্রস্টের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারটি বিবিসিতে প্রচারিত হওয়ার পর পরই সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ নতুনভাবে সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাজ্যের কেন্টে ১৯৩৯ সালের ৭ এপ্রিল জন্ম নেন ডেভিড ফ্রস্ট। পড়াশোনা করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সাংবাদিকতা, টেলিভিশন উপস্থাপনা, রম্য লেখাসহ বিভিন্নধর্মী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন বিবিসিতে কাজ করার পর ২০০৬ সালে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার জন্মলগ্নে এরসঙ্গে যুক্ত হন ডেভিড ফ্রস্ট। তিনিই একমাত্র টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, যিনি ১৯৬৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বপালনরত ৮জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ১৯৬৯ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দায়িত্বে থাকা ৭জন মার্কিন প্রেসিডেন্টেরও সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনন্য কীর্তি স্থাপন করেন তিনি। এছাড়া ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ইরানের শাসক রেজা শাহ পাহলভীর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী শেষ ব্যক্তিও তিনি।
উল্লেখ্য, ২০ সেপ্টেম্বর গ্রিনিচমান সময় ২০টায় প্রচারিত হয় এ তথ্যচিত্রটি। পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ডেভিড ফ্রস্টের নির্মিত এটিই ছিল সর্বশেষ তথ্যচিত্র। এ তথ্যচিত্রের তথ্য সংগ্রহের জন্য চলতি বছর জুন মাসে ফ্রস্ট বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সময় শেখ হাসিনাকে নিয়ে তিনি টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর কবর পরিদর্শন করেন এবং শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাক্ষাৎকারও নেন। তথ্যচিত্রটি শেষ হয়েছে কিনা ফ্রস্টের মৃত্যুর পর অনেক কানাঘুষা চলছিল। অবশেষ এটি প্রচারের মাধ্যমে সে কানাঘুষার সমাপ্তি ঘটলো। তথ্যসূত্র: অনলাইন।