দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মানুষ কথায় বলে হাতি পোষা আর… পোষা সমান কথা। তারমানে হচ্ছে হাতিদের পেছনে যে খরচ তাতে একমাত্র রাজা-বাদশা ছাড়া আর কারো পক্ষে পোষা এক কথায় অসম্ভব।
্আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন্ প্রাণী দিনের ৮০ শতাংশ সময় খরচ করে শুধু খাওয়া-দাওয়ার জন্য? আপনি কি এর উত্তর দিতে পারবেন। উত্তর হচ্ছে হাতি। এরা পরিমাণে যেমন বেশি খায় তেমনি আবার আস্তে আস্তে খাওয়ার কারণে সময় লাগে বেশি। হাতিদের খাওয়া এবং তাদের পরিবার পরিজনের বিভিন্ন কাহিনী তুলে ধরবো আজ।
কি পরিমাণ আহার করে হাতি
এদের আবার খাওয়ার পরিমাণ কম-বেশি হয় ঋতুর রকমফেরে। আমিষ নয়, এদের খাবারের তালিকায় শুধুই নিরামিশ ‘পদ’। বর্ষাকালে এদের মেন্যুতে থাকে নতুন ঘাস থেকে শুরু করে গাছের পাতা, কলা গাছ, গুঁড়ি, ফলমূল, গাছের ছাল- এসব। পরিমাণটাও শুনলে যে কেও অবাক না হয়ে পারবে না। দিনে এরা ১৪৯-১৬৯ কেজি পর্যন্ত খাবার খায়! এদের পানিও লাগে প্রচুর। প্রতিদিন ৬৮.৮-৯৮.৮ লিটার। কারও কারও দিনে পানি লাগে ১৫২ লিটার। একটি পূর্ণবয়স্ক হাতি পানি খেতে পারে ২১২ লিটার পর্যন্ত। আর এই পরিমাণ পানি খেতে এদের সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট!
উচ্চতা ও ওজন
হাতিদের উচ্চতা ১৩/১৪ ফুট বা কখনও কখনও তারও বেশি। তবে এদের গড় উচ্চতায় ১৪ ফুটের মতো। শুঁড় থেকে লেজ পর্যন্ত লম্বা মোটামুটি ৩০ ফুটের মতো। হাতির ওজন ৩ থেকে ৫ টন। হাতিদের বিশেষ করে ছোট হাতিদের ওজনের কথা শুনলে চক্ষু ছানাবড়া! প্রায় দুই টনের মতো।
হাতিদের ইতিহাস
হাতি। ইংরেজিতে ‘এলিফ্যান্ট’ শব্দটি ‘এলি’ এবং ‘ফ্যান্ট’ এই দুটি লাতিন শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘হিউজ আর্চ’ বা ‘বড় খিলান’। হাতিদের মধ্যে প্রধানত দুটি ভাগ আছে, আফ্রিকান ও এশিয়ান। এই দুটি প্রজাতির মধ্যে কপাল থেকে শুরু করে শুঁড় এবং কানের দৈর্ঘ্য, এমনকি শরীরের গঠনের দিক থেকে নানা অমিল চোখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি হাতি পাওয়া যায় ভারতে- প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজারটি। ২০০৩ সালের জুন পর্যন্ত এশিয়ান হাতির সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের কাছাকাছি এবং আফ্রিকান হাতির সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের মতো।
হাতি কেমন পরিবেশে থাকতে ভালোবাসে
আমরা যেমন পরিবারের সঙ্গে থাকতে ভালবাসি, ঠিক তেমনই হাতিও ঘন জঙ্গলে সব সময় দলবদ্ধভাবে এবং এক একটি পরিবার তৈরি করে থাকে। এই বিষয়টি মাঝে মধ্যেই জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দেখা যায়- দলবদ্ধভাবে হাতিরা কিভাবে বসবাস করছে। দলের মধ্যে প্রায় ৮ থেকে ১০০টি হাতি থাকে। একটি হাতি যখন জন্মায়, তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা থেকে শুরু করে খাওয়ানোর দায়িত্ব থাকে মা-হাতির ওপর। মা-হাতি শুঁড় দিয়ে তার বাচ্চার শুঁড়টা এমনভাবে জড়িয়ে ধরে, যাতে সে কোথাও হারিয়ে না যায়! বনে-জঙ্গলে খেলতে-খেলতে কোথাও চলে গেলে, তার মায়ের ডাকে সে আবার ফিরেও আসে। এমনকি হারিয়ে গেলেও দলের প্রতিটি সদস্য তন্নতন্ন করে বনের আনাচেকানাচে খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়ে। বলা যায়, আদরের ছোট্ট হাতিকে রক্ষা করে পুরো দল। আর দলটি চালনা করে পরিবারের মধ্য বয়সের সবচেয়ে বয়স্ক হাতিটি। তার নির্দেশের ওপরই নির্ভর করে বাকি হাতিদের চলাফেরা। সে যে শুধু দলের ওপর কর্তৃত্বই করে তা কিন্তু নয়, পরিবারের সব দায়িত্বও তাকেই নিতে হয়। তাই তো দলের পাণ্ডা হিসেবে তাকেই খাবার ও জলের সন্ধান রাখতে হয়।
হাতিরা গরমকালে নিজেদের ঠাণ্ডা রাখার জন্য কাদামাখা জায়গা খুব পছন্দ। এমনকি ছোট জলা জায়গায় গড়াগড়ি করে খেলতে বা দুষ্টুমি করতে হাতিরা খুব ভালবাসে। এ সময় মা-হাতি লম্বা শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে তার বাচ্চার গায়ের ধুলোকাদা সব মুছে ফেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে।
বিপদে-আপদে একজোট হাতি
হাতিরা সব সময় একজোট হয়ে থাকে বলে আপদে-বিপদে একে অন্যকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। বনের মধ্যে বিপদ তো সব সময় ওত পেতে থাকে। তবে পশুরাজ সিংহ কিংবা বাঘের মতো হিংস্র মাংসাশী প্রাণীরা অন্যদের ওপর বীরত্ব ফলালেও হাতিদের বিশাল চেহারা দেখে কিন্তু ছুটে পালায়! তবে বচ্চা হাতিরা অনেক সময় এদের লোভের শিকার হলেও সব সময় দলবদ্ধভাবে থাকে বলে ছোটরা বিপদে পড়লে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে বড়রা।
প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী হাতি
হাতিদের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। অনেক বছর আগের ঘটনাও হাতিদের মনে কিন্তু একেবারে টাটকা থাকে। তারা প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে না। তাই এদের সঙ্গে শত্রুতা করলে নিষ্কৃতি পাওয়া মুশকিল। তবে হাতির চোখ খুব খুদে, শরীরের তুলনায় একদমই বেমানান! ৩০ থেকে ৬০ ফুটের বেশি দূরত্বে খুব একটা ভালো দেখতে পায় না। কিন্তু লম্বা শুঁড়ের সাহায্যে স্পর্শ করেই বুঝতে পারে জিনিসের বৈচিত্র। মানুষের মতো হাতির রয়েছে খুব সংবেদনশীল মন। তাই দুঃখ পেলে এদের চোখে জল পর্যন্ত চলে আসে। হাতির চেহারা বিশাল বলে অন্য বন্যপ্রাণীরা আক্রমণ করতে ভয় পেলে কী হবে, অসুখ-বিসুখ তো হয়ই। কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, আর্থাইটিস, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগ মাঝে মধ্যেই কাবু করে ফেলে হাতিদের। হাতির শরীরটি বিশাল হলে কী হবে, তার মাথাটি কিন্তু সরস। এদের বুদ্ধির কাছে কোনো বন্যপ্রাণী টেক্কা দিতে পারে না। তবে হাতি খুব শান্ত স্বভাবের প্রাণী। হাতিকে আঘাত না করলে সেও কাওকে আক্রমণ করে না। আক্রমণ করার সময় সে কখনও পিছিয়ে পড়ে না।
হাতিদের আয়ু কেমন
হাতিদের গড় আয়ু মোটামুটি ৭০ বছর। যখন কোনো হাতি মারা যায়, সে সময় অন্য হাতিরা মরা হাতির সামনে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে শোক পালন করে। এমনকি, শুঁড় দিয়ে সেই মরা হাতিকে স্পর্শও করে। মাঝে মাঝে সঙ্গীর মৃতদেহ নিজেরাই বয়ে নিয়ে যায়। তবে মানতেই হবে, প্রাচীনকাল থেকে এখনও পর্যন্ত আমরা নানাভাবে এই বন্যজন্তুটির ওপর নির্ভরশীল। হাতি প্রাচীনকালে রাজারাজড়াদের চলার পথের যেমন সঙ্গী হত, তেমনই এখনও অনেক পাহাড়ি অঞ্চলে আমরা আমাদের চলাফেরার সুবিধার জন্য হাতিকেই সঙ্গী করি।
শেষ কথা
পৃথিবীর অনেক প্রাণীর মধ্যে এই বিশাল জন্তুটিকে আমরা হয়তো অনেকভাবেই অবহেলা করে থাকি। কিন্তু এই জন্তুটি আমাদের সব সময় উপকার করে গেছে। হয়তো মাঝে মধ্যে শোনা যায় বন্য হাতির আক্রমণের কথা কিন্তু সেটি একেবারেই নগন্য। তাছাড়া শুধু হাতি কেনো মানুষের মধ্যেও তো রয়েছে ভালো-মন্দ। তাই আসুন এই প্রাণীটিকে আমাদের এই জগৎ সংসারে টিকিয়ে রাখতে সকলেই কাজ করি। তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর অনলাইন।