দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক॥ নেলসন ম্যান্ডেলা একজন নেতার নাম যার নীতি কখনো অন্যায়ের কাছে নত হয়নি, নোবেল বিজয়ী গনমানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা মানুষের জন্য নিজের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় জেল খানায় কাটিয়েছেন এবং রেখে গেছেন অনেক অমূল্য বানী যা আজ আমাদের জন্য মূল্যবান সম্পদ, নেলসন ম্যান্ডেলা আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে যুগে যুগে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনে বিভিন্ন সময়ে দেয়া বিভিন্ন বক্তিতা ও মহান এই নেতার জীবনের শুরু থেকে শেষে বিভিন্ন উত্থান পতন চরাই উৎরাই বিষয়ে সংক্ষেপে বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে আজকের দি ঢাকা টাইমসের এই প্রতিবেদনে।
পূর্ণ নাম নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই, ম্ভেজো গ্রামে থেম্বু রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। থেম্বু জাতিগোষ্ঠীর রাজার পুত্র ম্যান্ডেলা ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলার পিতামহ । ম্যান্ডেলা নাম নেলসন ম্যান্ডেলার বংশীয় নাম। যদিও নেলসন ম্যন্ডেলা এবং তার পিতা রাজ বংশের সন্তান ছিলেন কিন্তু তারা রাজা হওয়ার কোন সুযোগ পাননি কারণ নেলসনের পিতামহী ইক্সহিবা গোত্রের হওয়ায় রীতি অনুযায়ী তাঁর শাখার কেউ থেম্বু রাজবংশে আরোহণ করার অধিকার রাখেন না।
১৯৬১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার দেয়া প্রথম টিভি ইন্টারভিউঃ
নেলসন ম্যন্ডেলার মায়ের নাম নোসেকেনি ফ্যানি যিনি পরবর্তীতে স্বামীর ঘর ছেড়ে নিজের পিতার বাড়িতে বসবাস শুরু করেন সেই সুবাদে নেলসন ম্যন্ডেলার মায়ের সাথেই নানার বাড়িতে শৈশব কাটে। শিশু বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দুরন্ত ফলে সে সময় সবাই তাকে “রোলিহ্লাহ্লা” নামেই ডাকতো। “রোলিহ্লাহ্লা” অর্থ দুষ্ট ছেলে।
ধীরে ধীরে নেলসন মেন্ডেলা বড় হতে থাকেন, স্কুল পাস করে তিনি ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অফ আর্টস কোর্সে ভর্তি হন। এখানে এসেই মূলত নেলসন ম্যান্ডেলা দেশ, রাজনীতি, সমাজ নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠেন। ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় নেলসন ম্যন্ডেলাকে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে, এর পর নেলসন ম্যান্ডেলা একটি খনিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে চাকরী করেন কিন্তু সেখানেও বেশি দিন তার চাকরী স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীকালে ম্যান্ডেলা জোহানেসবার্গের আইনী প্রতিষ্ঠান উইটকিন, সিডেলস্কি অ্যান্ড এডেলম্যানে কেরানি হিসাবে যোগ দেন। সেখানে মেন্ডেলার আইনি জীবনের শুরু, সেখানে চাকরী করার সুবাদে নানান মানুষের সাথে নেলসন ম্যান্ডেলার পরিচয় হয় এবং তিনি ম্যান্ডেলা ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর পরে ম্যান্ডেলা ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটার্সরান্ডে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। পড়া শোনা করার সময় অনেক বন্ধুর সাথে তার পরিচয় হয় এবং তিনি বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এসময় তার বন্ধুরা তার সঙ্গী হয়।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দেয়া প্রথম ভাষণঃ
http://youtu.be/xZ9KlXCkb2s
নেলসন ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালের জনগণের সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই সম্মেলনে মুক্তি সনদ প্রণয়ন করা হয়, যা ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে ম্যান্ডেলা সহ ১৫০ জন বর্ণবাদ বিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার করে। ১৯৬১ সালে ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখোন্তো উই সিযওয়ে (অর্থাৎ “দেশের বল্লম”, সংক্ষিপ্ত নাম MK) এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
নেলসন ম্যান্ডেলা অবশ্য সসস্র আন্দোলনকে পছন্দ করতেননা কিন্তু তিনি তার একাধিক বক্তিতায় বলেন, আমি সব সময় অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী, সসস্র আন্দোলন সব চেষ্টার শেষ চেষ্টা, মানুষ বাধ্য হয়ে অস্র হাতে নিয়ে যুদ্ধে নামে।”
নেলসন ম্যান্ডেলার সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে ভিডিওঃ
১৯৬২ সালের ৫ই আগস্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে জোহানেসবার্গের দুর্গে আটক রাখা হয়। ১৯৬৪ সালের ১২ই জুন দেয়া রায়ে ফাঁসীর বদলে নেলসন ম্যান্ডেলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তাঁর ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। মূলত জেলে থাকার সময়েই নেলসন ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৬৯ সালে আফ্রিকার বর্ণবাদি সরকার একটি পরিকল্পনা করে যাতে তারা কারাগারে নেলসন ম্যান্ডেলাকে জেল থেকে মুক্ত করার একটি মিথ্যা অভিযান চালাবে এবং সেই অভিজাতে নেলসন ম্যান্ডেলাকে ক্রস ফায়ার করে হত্যা করা হবে কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের খবর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা জেনে ফেলায় তা নস্যাত হয়ে যায়।
মোহাম্মদ আলীর সাথে হাস্যরসে নেলসন ম্যান্ডেলাঃ
১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলস্মুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ধারণা করা হয় ঐ সময় রবেন দ্বীপে তরুণ কারা কর্মকর্তা এবং বন্ধীদের উপর নেলসন ম্যান্ডেলার বিশাল প্রভাব দেয়া যায় ফলে সেই প্রভাব কমাতেই এই উদ্যোগ। সেই সময়ে রবেন কারাগারকে ব্যাঙ্গ করে বলা হত “ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়”।
১৯৮৫ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় যা নেলসন ম্যান্ডেলা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি এই বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন যাতে ছিলঃ
“What freedom am I being offered while the organization of the people remains banned? Only free men can negotiate. A prisoner cannot enter into contracts.”
অনুবাদঃ এ কেমন প্রস্তাব! যেখানে আমাকে মুক্তির বিনময়ে একটি জনমানুষের সংঘঠনকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়! একজন মুক্ত মানুষ শর্ত নিয়ে আলোচনা বা চুক্তি করতে পারে, কোন বন্ধী কখনো কোন চুক্তিতে যেতে পারেনা।
১৯৯০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সহ অন্যান্য বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। একই সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়া হয়, এসময় ম্যান্ডেলার মুক্তির দৃশ্য সারা বিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল।
মুক্তির দিন নেলসন ম্যান্ডেলা একটি ভাষণ দেন যেখানে তিনি বলেনঃ
“১৯৬০ সালে আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হই। বর্ণবাদের হিংস্রতার হাত থেকে আত্মরক্ষার খাতিরেই আমরা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখান্তো উই সিযওয়ে গঠন করেছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার পেছনের কারণগুলো এখনো রয়ে গেছে। তাই এ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো পথ নেই। আমরা আশা করি, শান্তি আলোচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অচিরেই সৃষ্টি হবে এবং আমাদের আর সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দরকার থাকবে না।”
১৯৯০ হতে ১৯৯৪ পর্যন্ত সময়ে নেলসন ম্যান্ডেলা সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় বসেন, এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হবার পর ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯৪ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সফলভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৯ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহন করেন।
নেলসন ম্যান্ডেলার জাতিসংঘে ভাষণঃ
প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা কালীন শেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের নীতি গ্রহণ না করার জন্য এই মহান বিপ্লবী দেশে বিদেশে প্রশংসিত হন।তিনি ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার সহ ২৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন।
নিজ দেশে অলিম্পিক আয়োজনের ভাষণে নেলসন ম্যান্ডেলাঃ
নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে এসেছিলেন।জানিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার অশেষ ভালবাসার কথা।
দুবাই স্পেশাল অলিম্পিকে নেলসন ম্যান্ডেলাঃ
এই মহান নেতা ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়ে মৃত্যু বরন করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ এই বিপ্লবী নেতাকে আদর করে মাদিবা বলে ডাকেন। মাদিবা হয়ত আর মানুষের অধিকারের কথা বলতে আসবেনা, কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শ এবং উক্তি সমূহ যুগ যুগ ধরে শোষিত মানুষের সাহসের হাতিয়ার হয়ে থাকবে।
ভিডিও সূত্রঃ ইউটিউব