ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ইলিশ ছাড়া আগে রোজা হতো না। সেহরির সময় যেনো ইলিশের কোন আইটেম থাকতেই হবে। কিন্তু এখন সে দিন আর নেই। শুনেছি কলকাতার মানুষরা নাকি ইলিশের জন্য লালায়িত থাকতেন। এখন বাংলাদেশের মানুষের অবস্থাও হয়েছে ঠিক তেমনি।
সাগরে ইলিশের দেখা নেই। দিনের পর দিন জাল ফেলেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না রূপালি ইলিশ। গোন শেষে তারা ফিরে আসছে শূন্য হাতে। জালে ইলিশ ধরা পড়ার কোন খবর না থাকায় অনেকে ইতিমধ্যে সাগরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মৌসুমের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলেও জেলেরা রয়েছে অব্যাহতভাবে লোকসানের মুখে। জেলেপল্লীগুলোতে চলছে এখন হাহাকার। ইলিশের আকাল দেখা দেয়ায় উপকূল এলাকার মসজিদগুলোতে চলছে কোরআন খতম ও মিলাদ মাহফিল।
এদিকে ইলিশের আকাল দেখা দেয়ায় উপকূল এলাকায় দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। জানা যায়, বৈশাখের শুরুতে ইলিশ মৌসুম শুরু হয়েছে। তিন মাস পার হলেও সাগরে দেখা মিলছে না রূপালি ইলিশ। শরণখোলার মৎস্য আড়তদার দেলোয়ার হোসেন ফরাজি জানান, অধিকাংশ ফিশিং ট্রলার চলতি ইলিশ মৌসুমে সাগরে তিন থেকে পাঁচটি ট্রিপ দিয়েছে। এর মধ্যে একটি ট্রিপে কেও কেও মূল পুঁজি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত মালিকরা ট্রলার প্রতি দুই থেকে তিন লাখ টাকা লোকসানে রয়েছে। এর মধ্যে যারা সাগরে গিয়ে জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল তারা রয়েছে আরও বেশি লোকসানে।
রায়েন্দা বাজারের কবির আড়তদার জানান, গত গোনে ৯০ ভাগ ট্রলার মালিককে লোকসান গুনতে হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে সাগর থেকে ফিরেছে শূন্য হাতে। তার মালিকানাধীন এফবি মা-বাবার দোয়া ও খায়রুল ইসলাম ফিশিং ট্রলারে দুই লাখ টাকা খরচ করে সাগরে গিয়েছে। ফিরে আসার পর একটিতে এক হাজার ২০০ ও অপরটিতে এক হাজার ৩০০ টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে। এভাবে রায়েন্দা বাজারের শহিদুল ফকিরের এফবি অনামিকা ট্রলারের মাছ এক হাজার টাকা, আঃ হাইয়ের আল্লার রহমত এক হাজার ৫০০ টাকা, কামাল মিয়ার এফবি মুন্না-২ তিন হাজার ৯০০ টাকা ও আনোয়ার আড়তদারের তানজিরা দুই হাজার ৫০০ টাকার ইলিশ বিক্রি করেছে। এভাবে উপকূল এলাকার হাজার হাজার ফিশিং ট্রলার মালিক লোকসানের মুখে পড়েছে। বরগুনা জেলা ফিশিং ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আঃ মান্নান জানান, গত গোনে পাথরঘাটার ৩০০ থেকে ৪০০ ফিশিং ট্রলার ইলিশ ধরতে সাগরে গিয়েছিল। তার জানা মতে, পাথরঘাটা সদরের সালাম দোকানদার ও বাদুরতলার আলম মিয়া ব্যতীত কারও পুঁজি ওঠে আসেনি। শূন্য হাতে ফিরেছে অসংখ্য ট্রলার। এর মধ্যে সেলিম চৌধুরীর ২টি ও লতিফ মিয়ার এফবি মায়ের দোয়াসহ অনেক ট্রলার রয়েছে। তিনি জানান, ইলিশ ধরা না পড়ায় পাথরঘাটা, মহিপুর, আলীপুরসহ গোটা উপকূলে এখন থমথমে অবস্থা। জেলেরা তাদের পরিবার নিয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে। বাজারগুলোতে বেচাকেনা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত বছর এ সময় পাথরঘাটা মৎস্য আড়ত কেন্দ্রে যেভাবে জমজমাট ভাব ছিল, সেখানে এখন খাঁ খাঁ করছে। তিনি আরও জানান, ইলিশ খরা কাটানোর জন্য ১৩ জুলাই পাথরঘাটা বিএফডিসিতে দিনব্যাপী কোরান খতম ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এভাবে উপকূলের অন্যান্য স্থানেও মিলাদ ও কোরান খতম অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে তিনি জানান। শরণখোলা উপজেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন জানান, গত গোনে অসংখ্য ফিশিং ট্রলার ফিরেছে শূন্য হাতে। লাখ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়ে শূন্য হাত ফিরে আসায় মালিকসহ ট্রলারের জেলেরা (ভাগীরা) পথে বসার উপক্রম হয়েছে। তিনি আরও জানান, তার মালিকানাধীন এফবি মুন্না-৩ ও মুন্না-১ ফিশিং ট্রলার দুটিতে দুই লাখ টাকার বাজার সদায়, ডিজেল ও অন্যান্য মালামাল দিয়ে সাগরে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরেছে শূন্য হাতে। উপজেলা মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান তালুকদার জানান, গত গোনে লোকসানে পড়ে অনেক মৎস্যজীবীরা (ট্রলার মালিকরা) পথে বসেছে। পরের গোনে (চলতি গোনে) পুঁজি সংগ্রহ করে ট্রলার সাগরে পাঠানোর মতো সামর্থ্য অনেকেরই হয়ে ওঠেনি। ফলে চলতি গোনে অসংখ্য মালিকরা তাদের ফিশিং ট্রলার সাগরে পাঠাতে পারেনি। উপকূল এলাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী জেলে। মৌসুমে ইলিশ দেখা দিলে বাজারগুলো সরগরম হয়ে ওঠে। আর ইলিশের আকাল হলে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। আর সেই মন্দাই দেখা দিয়েছে উপকূলজুড়ে। বিভিন্ন বাজারের দোকানিদের বেচাকেনা কমে গেছে। রায়েন্দা বাজারের মুদি ও স্টেশনারি দোকানি মোস্তফা কামাল জানান, ইলিশ ধরা না পড়ায় তাদের বেচাকেনা অর্ধেকে নেমে এসেছে। হাটের দিনেও বাজারে লোকজন আসছে না। অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে জেলে পরিবারগুলো।