ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিজের হাতে গড়া নুহাস পল্লীর লিচুবাগানের শ্যামল ছায়ার শীতল মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুয়াযী গাজীপুরের নুহাস পল্লীতে ২৪ জুলাই দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।
২৪ জুলাই সকালে বারডেমের হিমঘর থেকে বাংলা কথাসাহিত্যের বরপুত্র নন্দিত নায়ক হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরের নুহাস পল্লীতে। প্রিয় মানুষটির শেষ জানাজার আগে আকাশ ভেঙে নেমে এসেছিল শ্রাবণ মেঘের ধারা। নুহাস পল্লীতে সমবেত শোকাতুর স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের চোখের পানির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টির পানি। নুহাস পল্লীর সবুজে ঘেরা পরিবেশে হুমায়ূন আহমেদকে শেষ বিদায় জানাতে আসা অগণিত ভক্ত, স্থানীয় বিশিষ্টজন, সাধারণ মানুষ ও পরিবারের সদস্যরা বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে জানাজার নামাজ আদায় করেন। এই বৃষ্টির পানি যেনো সবুজে ঢাকা গাছ-পালার চোখের পানি হয়ে নেমে এসেছিলো।
গাজীপুরের পিরুজালি গ্রামে ১৯৯৭ সালে ২২ বিঘা জমি কিনে যে বাগানবাড়ির পত্তন করেছিলেন, ১৫ বছর পর সেই বাড়ির লিচুতলাতেই কবর হল নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের (১৩-১১-১৯৪৮-১৯-৭-২০১২), আত্মীয়স্বজন সবার উপস্থিতিতে ২৪ জুলাই বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে তার দাফন শুরু হয়। বড় ছেলে নুহাশ আহমেদ বাবার খাটিয়ায় কাঁধ দেন। নিজেই কবরে নেমে প্রিয় বাবাকে কবরের শীতল মাটিতে শুইয়ে দেন। মুঠোভর্তি মাটি ছিটিয়ে দাফনের কাজ শুরু করেন। লেখকের দ্বিতীয় স্ত্রীর দুই শিশুসন্তান নিষাদ ও নিনিতও বাবার কবরে মাটি দিয়েছে।
এর আগে বেলা দেড়টায় বৃষ্টির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় লেখকের তৃতীয় ও শেষ জানাজা। ২০ জুলাই নিউইয়র্কের ইসলামিক সেন্টারে এবং ২৩ জুলাই ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ মাঠে দু’বার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় তার। তুমুল বৃষ্টির কারণে গতকাল জোহর নামাজের পর একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও জানাজা শুরু করা যায়নি। শেষতক নুহাশ পল্লীভরা মানুষ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই জানাজা আদায় করেছেন। জানাজা পড়িয়েছেন স্থানীয় ইমাম মুজিবুর রহমান মুন্সী। ইমামের পাশে দাঁড়িয়েই জানাজা আদায় করেন নুহাশ। এদিন তিনি পরেছিলেন নীল রঙের পাঞ্জাবি। জানাজা শেষে নুহাশ পল্লীর সর্বত্র উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তি দুই হাত তুলে অশ্রুসজল নয়নে তার জন্য প্রার্থনা করেন। স্মরণকালে আর কোন মানুষের বিদায়কালে এমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধা এবং হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা প্রকাশ করেনি বাঙালি।
লেখকের শেষযাত্রায় শামিল হতে আসা বন্ধু প্রকাশক আলমগীর হোসেন, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচসহ অন্যরাও কাঁদছিলেন এ সময়। লেখকের কফিনে ফুল দিয়ে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ নুরুল ইসলাম, গাজীপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক মোঃ আখতারুজ্জামান, গাজীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আকম মোজাম্মেল হক, টঙ্গী পৌরসভার মেয়র আজমত উল্লাহ খান, শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সবুজ, গাজীপুর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন, গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ। হুমায়ূনের মরদেহ নুহাশ পল্লীতে ঢোকার পরপরই দুটি প্রাডো জিপে চড়ে আসেন শাওন, তহুরা আলী, শাওনের বাবা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী এবং শাওনের আত্মীয়রা। এরা সবাই লাশের বহরের সঙ্গেই ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিলেন।
এর আগে দুপুর পৌনে ১২টায় মাইক্রো বাস ও গাড়িযোগে সেখানে গিয়ে পৌঁছেন হুমায়ূনের প্রথম পক্ষের তিন সন্তান নোভা, শিলা ও নুহাশ আহমেদ। সঙ্গে ছিলেন ভাই আরেক কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব, বোন কবি নজরুল ইসলাম কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ভাইস প্রিন্সিপাল সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ, ভাইয়ের বউ ইয়াসমিন হক, হুমায়ূনের খালা রেজিয়া খানম, আনোয়ারা বেগম এবং পরিবারের অন্য আত্মীয়রা। তারা গাড়ি থেকে নামার পরপরই পুলিশি কর্ডনের মধ্য দিয়ে নুহাশ পল্লীর বাংলো বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েন। এ সময় সংবাদকর্মীরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও কোন সুযোগ পায়নি। পরিবারের সদস্যরা কোন কথা বলতে রাজি হননি।
নুহাশ পল্লীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য গতকাল এলাকায় ২৫০ পুলিশ, র্যাব ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। তাকে শেষবারের মতো বিদায় দিতে অনেকেই এসেছিলেন নুহাস পল্লীতে। তাদের প্রিয় মানুষটির এ অকাল তিরোধান সবাই কিছুতেই যেনো মেনে নিতে পারছিলেন না। চোখের পানি ও বৃষ্টির পানি যেনো একাকার হয়ে গিয়েছিল।