ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ এনে তার দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশ’র স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। নজরুল ইসলাম নামে এক আইনজীবী বাদী হয়ে ১ আগস্ট চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম বিএম নিজামুল হকের আদালতে এ মামলা দায়ের করেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গতকাল ১ আগস্ট খবরটি নিশ্চিত করে বলেছে, আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের এএসপিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। বাদি তার আর্জিতে বলেছে, শাওনের কাছে রক্ষিত হুমায়ূন আহমেদের বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ এবং মাজহারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য শাওন ও মাজহার পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশ করে হুমায়ূন আহমদকে হত্যা করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় দৈনিক আজাদী ও আমার দেশের বার্তা সম্পাদক এবং লেখক আবদুল হাই শিকদারকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এজাহারে বাদী নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ১৭ জুলাই নিউইয়র্কের বাসায় চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে হুমায়ূন আহমদের অপারেশনের সেলাই খুলে যাওয়ায় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপরও শাওন তাকে ওইদিন বেলভিউ হাসপাতালে না নিয়ে পরদিন অখ্যাত জ্যামাইকা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে হুমায়ূনের অবস্থার আরও অবনতি হলে নিজস্ব গাড়িতে করে নেয়া হয় বেলভিউ হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মিলারকে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা গোপন করেন শাওন ও মাজহার। এ কারণে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদ মারা যান। বেলভিউ হাসপাতালের চিকিৎসক স্পষ্ট বলেছেন, ক্যান্সারের কারণে তার মৃত্যু হয়নি। এজাহারে মামলার বাদী আরও উল্লেখ করেন, পত্রিকার সংবাদে জানা গেছে ,জ্যামাইকা হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার স্ত্রী শাওন যাননি। এমনকি চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার পরদিন হুমায়ূন প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে থাকলে অবস্থা বেগতিক দেখে শাওন নিউইয়র্কের মুক্তধারার প্রতিনিধি বিশ্বজিৎ সাহার কাছ থেকে ডাক্তারের ফোন নম্বর নেন। অথচ শাওন ও মাজহার দু’জনে হুমায়ূনের চিকিৎসা ও দেখাশোনার দায়িত্বে থাকলেও তারা ডাক্তারের ফোন নম্বর রাখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। অপারেশনের পর ১২ জুলাই হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে নিজের ভাড়া বাসায় ফিরলে ওইদিন সন্ধ্যায় পার্টির আয়োজন করেন শাওন। সে পার্টিতে ক্যান্সারের অপারেশন হওয়া অসুস্থ হুমায়ূনকে মাংস ও পানীয় খেতে দেয়া হয়। এছাড়া বেলভিউ হাসপাতালে হুমায়ূনের অপারেশনের সময় শাওন ও মাজহার প্রায় দু’ঘণ্টা অনুপস্থিত ছিলেন। অর্থাভাবে হুমায়ূনের অপারেশন বিলম্বিত হওয়ার কথা শাওন বললেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্ক সফরকালে হুমায়ূনকে দেখতে গিয়ে তার চিকিৎসার সব ব্যয়ভার বহনের প্রস্তাব দিলে শাওন টাকার অভাব নেই বলার পর হুমায়ূন প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর করে দশ হাজার মার্কিন ডলারের চেক হুমায়ূনকে দিয়ে এলেও পরবর্তীতে শাওন এই চেকও ফিরিয়ে দেন। অথচ শাওন বিভিন্ন মাধ্যমকে বলেছেন, অর্থ সংকটের কারণে বিশ্বখ্যাত স্নোয়ান মেমোরিয়াল ক্যাটারিং ক্যান্সার হাসপাতালে হুমায়ূনের চিকিৎসা অব্যাহত রাখা যায়নি। এছাড়াও ১৭ ও ১৮ জুলাই বিভিন্ন গণমাধ্যম শাওন ও মাজহারের কাছে হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে তারা কোন উত্তর দেননি। হুমায়ূনকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার বিষয়টিও তারা বলেননি। উল্টো শাওন ও মাজহার ঢাকার শীর্ষ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে প্রদত্ত বিবৃতিতে হুমায়ূনের অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানায়। মিডিয়ার কাছেও তারা লাইফ সাপোর্ট দিয়ে হুমায়ূনকে বাঁচিয়ে রাখার কথাটি গোপন করেন।
মামলার এজাহারে বাদী নজরুল আরও উল্লেখ করেন, হুমায়ূন আহমদের চিকিৎসক ডা. মিলার নিউইয়র্কের ঠিকানা পত্রিকাকে পরিষ্কারভাবে জানান, ক্যান্সারে হুমায়ূন মারা যাননি। স্নোয়ান মেরোরিয়াল ক্যাটারিং হাসপাতালের চিকিৎসকও হুমায়ূনকে শতভাগ সুস্থ বললেও শাওন ও মাজহার অর্থ সংকটের কথা বলে ক্যান্সারের বিশেষায়িত হাসপাতাল স্লোয়ান মেমোরিয়াল থেকে অবিশেষায়িত বেলভিউ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেই হাসপাতালেও শাওন ও মাজহার সময়মতো হুমায়ূনের চিকিৎসা করাননি। মামলার বাদী নজরুল উল্লেখ করেন, শাওন ও মাজহারের এসব আচরণে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, হুমায়ূন আহমেদের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি যা শাওনের কাছে গচ্ছিত আছে, তা আত্মসাৎ করার জন্য এবং মাজহারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ষড়যন্ত্রমূলকভাবে লোক দেখানো যেনতেন তুচ্ছতাচ্ছিলভাবে চিকিৎসার নামে সুপরিকল্পিতভাবে দু’জনে যোগসাজশ করে হুমায়ূনকে হত্যা করেছে। দৈনিক আজাদী ও আমারদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে এসব তথ্য জানতে পারেন বলে বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন। বাদীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ এবং মোঃ মাঈনুদ্দিন। মামলা দায়েরের পর বাদী নজরুল ইসলাম বলেন, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর আগে ও পরের ঘটনা প্রবাহ, শাওন ও মাজহারের সন্দেহজনক আচরণ, অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে পরিষ্কার এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য প্রমাণ সরবরাহ করা হবে। বাদী আরও বলেন, হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের গর্ব ও রাষ্ট্রের সম্পদ। দেশের প্রতিটি মানুষ মনে করে তার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। বরেণ্য এই কথাসাহিত্যিককে হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাদীর আইনজীবী কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ জানান, ঘটনা নিউইয়র্কে সংঘটিত হলেও পরিকল্পনাকারী ও পরিকল্পনার স্থান বাংলাদেশ। ফৌজদারি আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী দেশেই হত্যা মামলা করা হয়েছে। অন্য দেশের বিভিন্ন বিষয়াদি থাকায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা বেঁধে দেননি আদালত।
এদিকে এই মামলা দায়েরের পর আমরা চেষ্টা করেছি শাওনের সঙ্গে যোগাযোগের কিন্তু তাকে পাওয়া যায় নি। তবে হূমায়ুন প্রচণ্ড ভক্ত এমন কিছু ব্যক্তির মতামত জানতে চাইলে তারা বলেছেন, এটি একটি ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। ৯ মাস অনেক ত্যাগ শিকার করে শাওন হূমায়ুন আহমেদকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এটিই কি তার অপরাধ? তারা প্রশ্ন করেন অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম কেনই বা হূমায়ুন আহমেদকে মারতে যাবেন তার কি লাভ? বরং হূমায়ুন আহমেদ মারা যাওয়ায় তার ব্যবসায়ীক ব্যাপক ক্ষতিই হলো।
হূমায়ুন আহমেদকে দাফনের পর তার মা’কে সাংবাদিকরা এমন কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা বার বার প্রশ্ন করেছেন, আপনার ছেলের মৃত্যু কি স্বাভাবিক ছিল? প্রতি উত্তরে তিনি বলেছেন, আমার ছেলে অসুস্থ্য ছিল চিকিৎসা করা হয়েছে চেষ্টা করা হয়েছে সুস্থ্য করে তোলার কিন্তু হায়াত নাই তাই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।
তবে ঘটনা যায়ই ঘটুক না কেনো, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যটি জনগণ দেখতে চাই। কারণ দেশ-বিদেশের কোটি কোটি পাঠক হূমায়ুন আহমেদকে শ্রদ্ধা করে। তার মৃত্যু নিয়ে কেও রাজনীতি করুক তা সাধারণ জনগণ চাই না।